×

মুক্তচিন্তা

বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ‘একদলীয় শাসন’ ছিল না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৩, ১২:৩১ এএম

বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ‘একদলীয় শাসন’ ছিল না

প্রথমে বুঝে নেয়া দরকার ‘একদলীয় শাসন’ কোনটি? যখন সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা স্থগিত করে নির্বাহী আদেশে শাসন কাজ পরিচালিত হয়, তাই হলো ‘একদলীয় শাসন’। যেমনটি বাংলাদেশে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ এবং পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া ও জেনারেল জিয়াউল হক করেছিলেন। এরা সামরিক আইন জারি করে মূলত ‘একদলীয় শাসন’ কায়েম করেছিলেন। বাকশাল সে অর্থে ‘একদলীয় শাসন’ নয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সামরিক আইন জারি করেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ইতিহাস বিকৃতকারীরা বিরামহীনভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ‘একদলীয় শাসন’ কায়েম করেছিলেন। অনেক গণ্ডমূর্খ তা বিশ্বাসও করে। এদের সংখ্যা খুব কম নয়। মূলত তারা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাকশালকে (বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ) ‘একদলীয় শাসন’ বলতে চাইছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় জাতীয় রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ১১৭-ক অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি নতুন জাতীয় দল গঠন করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, যা একদিকে স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সংঘটিত নানাবিধ অনাচার প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেবে, অন্যদিকে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের ওপর জাতি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করবে। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চেয়ারম্যান হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল নামের সর্বদলীয় জাতীয় রাজনৈতিক দলটির জন্য ১৫ সদস্যের একটি নির্বাহী কমিটি এবং ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি মনোনীত করেন। এছাড়া জাতীয় কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ নামে দলের পাঁচটি অঙ্গসংগঠনকে মনোনয়ন দান করেন। ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে সরকারিভাবে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। তার আগে ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। বাকশাল অপরীক্ষিত থেকে যায়। বাকশাল ছিল সার্বিকার্থে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের রূপকল্প। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি। বাকশাল কোনো অবস্থায় ‘একদলীয় শাসন’ ব্যবস্থা নয়। এটি একটি প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলও ছিল না। এটি ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক দর্শন। বঙ্গবন্ধু একমাত্র রাজনৈতিক নেতা, যিনি দেশীয় প্রেক্ষাপটে, দেশজ সত্তা বজায় রেখে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে এ দর্শন উপস্থাপন করেন। অন্য যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দর্শন চর্চা করেছেন, তা ছিল বৈদেশিক দর্শন। বঙ্গবন্ধুর দর্শনের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু এটাকে ‘একদলীয় শাসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ নেই। এটা কোনো আবেগের কথা নয়। যুক্তির কথা। ‘একদলীয় শাসন’ ব্যবস্থা নয় বলার যুক্তিটা কী? বাকশাল যেহেতু একটি সর্বদলীয় জাতীয় রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ছিল, তাই সর্বদলীয় জাতীয় রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম কোনো দিন ‘একদলীয়’ হতে পারে না। এ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। পদাধিকার বলে বঙ্গবন্ধু প্রথমবার মনোনয়ন দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু গঠনতন্ত্রে সর্বস্তরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা ছিল। গভর্নর থেকে শুরু করে ছাত্রলীগ পর্যন্ত সব পর্যায়ে এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার কথা বলা ছিল। বাকশাল বাঙালির মাটি-মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য একমাত্র রাজনৈতিক দর্শন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আগে কিংবা পরে আর কোনো রাজনৈতিক নেতা এমনতর দর্শন উপস্থাপন করেননি। বাকশাল ‘একদলীয় শাসন’ নয়, এটি সর্বদলীয় জাতীয় রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। এ মতের পক্ষে আরো একটি যুক্তি হলো- বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামের দলটির সঙ্গে একীভূত হয়েছিল চারটি দল। দলগুলো হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মোজাফফর) ও জাতীয় লীগ। চারটি দলের সমন্বয়ে বাকশাল গঠিত হয়েছিল। চারটি দলের সমন্বয়ে গঠিত দল বা প্রতিষ্ঠানকে কখনো ‘একদলীয় শাসন’ বলা যায় না। বাকশালকে ‘একদলীয় শাসন’ বলা ইতিহাসের জঘন্যতম মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। এই মিথ্যাচারে লিপ্ত আছে দুটি গোষ্ঠী। একটি হলো ’৭৫-এর খুনিচক্র। অপরটি হলো উপনিবেশিক ধ্যান-ধারণাপুষ্ট একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। গোষ্ঠী দুটি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিথ্যাটিকে সত্যে পরিণত করতে বারেবারে বাকশাল নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের মিথ্যাচার খুবই বিরল ঘটনা। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে বাকশাল নামের অপরীক্ষিত দর্শনটির বিরুদ্ধে ’৭৫-এর খুনি চক্র মিথ্যাচারে লিপ্ত আছে। যেটি কাজই শুরু করল না, তার নানান ত্রæটি-বিচ্যুতি বের করা শুরু করে দিল। এখান থেকেই ষড়যন্ত্র এবং ষড়যন্ত্রকারীর উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট হওয়া পাওয়া যায়। আসলে খুনি চক্র ভিন্ন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই এ ধরনের মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। এ ভিন্ন উদ্দেশ্যটি হলো বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করানো। দেশ স্বাধীন হলেও দেশের একটি শ্রেণির মানুষ বিশেষ করে সমাজপতিরা (যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল) উপনিবেশিক ধ্যান-ধারণার অব্যাহত রাখার পক্ষে স্বাভাবিক কারণেই। তারা মূলত এমন একটি আধুনিক দেশজ ভাবনাকে গ্রহণ করতে পারেনি নিজেদের শ্রেণি চরিত্রগত কারণে। ফলে পশ্চাৎগামীরা তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এর বিরুদ্ধে আজ অবধি সোচ্চার থেকেছে। স্বাধীনতার পর দেশটির চালিকাশক্তি বঙ্গবন্ধুর হাতে থাকলেও ভেতরে ভেতরে উপনিবেশিক সাম্প্রদায়িক শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বিষয়টি ছিল আদর্শিক দ্ব›দ্ব। বিপ্লবের পরে যে প্রতিবিল্পব হয় তেমনটি। প্রতিবিপ্লবীরা বাকশালকে ‘একদলীয় শাসন’ বলে অপপ্রচার করছে। এদের বৃত্তান্ত ঘাঁটলে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধু প্রতিবিপ্লবকে ঠেকাতে বাঙালি জাতির স্বার্থে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামের আধুনিক জাতীয় গণতান্ত্রিক দলটিকে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন, তাই এ কার্যক্রমকে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বলেছিলেন। এর ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তখনই তো স্পষ্ট হয়ে গেছে, যারা সাম্যের বিরোধী, তারা এর সঙ্গে থাকবে না, এরা সাম্প্রদায়িকও। সাম্প্রদায়িকতার অপছায়া তখন দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এসব নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে ইতিবাচক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার রূপকল্প হিসেবে যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক অপশক্তির রাশ টেনে ধরতে বাকশালের মাধ্যমে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক জাগরণ ঘটিয়ে বাঙালি জাতির মনের অন্ধকার ঘোচাতে চেয়েছিলেন। অপপ্রচারকারীরা এখনো ব্যাপক মাত্রায় সক্রিয় বিধায় কাক্সিক্ষত বাকশাল নামের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের রূপকল্প প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক যতীন সরকার বলেছেন, ‘যা কাক্সিক্ষত তা সব সময় পূরণ হয় না। পূরণ হয় না বলেই এ আকাক্সক্ষা প্রতিনিয়ত বহমান থাকে। আকাক্সক্ষা বহমান থাকে বলেই তা পূরণের চেষ্টা আমরা প্রতিনিয়ত করে যাই। এ চেষ্টায় আমরা সব সময় সফল হই এমন নয়। স্বাধীনতা অর্জনের সময় আমরা যা চেয়েছিলাম তার অনেক কিছুই আজ হারিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পাকিস্তানের ভূত ফের আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসেছিল। এই ভূত এখনো আমাদের নানাভাবে বিপর্যস্ত করে। কিন্তু এই ভূত তাড়ানোর চেষ্টা যে চলমান নয়, সে কথা বলা যাবে না। অবশ্য এ কথা মানতে হবে, প্রবীণদের উচিত ছিল তরুণদের সচেতন-উদ্বুদ্ধ করার। এ দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি।’ তাই আজো বাকশালকে ‘একদলীয় শাসন’ বলে কলঙ্কিত করা হয়। আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটেছে। মননের উন্নয়ন ঘটেনি। উপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তানপন্থি ভাবধারা ফলগুর মতো আজো বহমান। কিন্তু এ থেকে মুক্তি পেতে হলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শক্ত একটি সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাতে হবে।

কুমার প্রীতীশ বল : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App