×

মুক্তচিন্তা

বিবেচনাহীন শেয়ারিং প্রতিযোগিতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৩, ০৬:১১ পিএম

বিবেচনাহীন শেয়ারিং প্রতিযোগিতা

কাজী বনফুল, লেখক ও কলামিস্ট। ছবি: সংগৃহীত

একজন বিজ্ঞান জানা ব্যক্তিকে দেখলাম সেদিন ফেসবুকে লিখেছেন, ছি, ছি, ছি এতদিন যাবৎ কি তাহলে আমরা কুকুরের মাংসই খেয়েছি!

আমার প্রশ্ন হচ্ছে কোন একজন সুলতান ডাইনসের খাবারে কুকুর বা বিড়ালের মাংস সংক্রান্ত বিষয়ে ফেসবুকে পোষ্ট করেছেন। তার এই পোষ্ট করার পেছনে বিভিন্ন কারন থাকতে পারে সেটা হতে পারে মাংসের সাইজ অপছন্দ হওয়া, মাংসের হাড় চিকন হওয়ার দরুণ সন্দেহ করে বা কোন ব্যবসায়িক পলিসির কারনে অথবা কোন চাপা ক্ষোভ থেকে, সেটা যাই হোক হতে পারে যে কোন কিছু। সেই ব্যক্তি ফেসবুকে পোষ্ট করার সাথে সাথেই সবাই এক রকম ফিক্সড হয়ে গেছে যে এটা অবশ্যই কুকুর বা বিড়ালের মাংসই ছিল এবং আমরা এযাবৎকালে যারা সেখানে খেয়েছি তারা অবশ্যই কুকুরের মাংসই খেয়েছি। এটা মূলত এক প্রকার মনস্তাত্ত্বিক ক্রাইম যা ব্যক্তির ভেতরে থাকা স্বতঃস্ফূর্ত চেতনাকে অবচেতন ভাবে আঘাত করে। আর এই অপরাধের মাধ্যম হয়েছে আমাদের ফেসবুক এবং তার কর্ণধার হচ্ছি আমরা। ব্যবহারের উপরেই যে কোন বস্তুর উপযোগিতা নির্ভর করে।

আমাদের দেশের ফেসবুক ইউজাররা সাধারণত কোন কিছুর মূল ফ্যাক্ট যাচাই বাছাই করার কোন প্রয়োজন অনুভব না করেই যে কোন কিছুই ফেসবুকে সাবলীল ভাবে শেয়ার করে দেয়, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া সমাজে কি প্রভাব বিস্তার করতে পারে তার কোন চিন্তা তারা কখনোই করে না। কিন্তু একজন বিজ্ঞান জানা মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষিত মানুষজন ও দেখলাম ফেসবুকের ধাঁধায় বাঁধা পড়ে কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই বিশ্বাস করে ফেলছে যে সেটা অবশ্যই কুকুরের মাংসই ছিল। সেই সাথে নানা রকম থিওরি নানা রকম বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন ফেসবুকে এবং সবাই একযোগে সামিল হচ্ছে সেই চিরন্তন মজমায়।

এবার আসি আসল প্রসঙ্গে, কোন প্রকার ল্যাব টেস্ট ছাড়া এক টুকরো মাংসের সাইজ বা হাড় চিকন দেখে কেউ কিভাবে বলতে পারে যে সেটা কোন পশুর মাংস। এটা কোন ভাবেই সম্ভব নয় কারন ৮ বছরের শিশুর হাড় এবং ২৫ বছরের যুবুকের হাড়ের মাঝে ও শারীরিক গঠনের মাঝে যেমন বিস্তার ফারাক থাকে ঠিক তেমনি কম বয়সী ছাগল এবং বেশি বয়স্ক ছাগলের হাড়ের মাঝেও পার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এখন যদি কেউ ফেসবুকে পোষ্ট করে যে স্টার হোটেলে যে প্রতিদিন শত শত খাসির লেগ রোস্ট খাওয়ানো হয় এত খাসির লেগ রোস্ট তারা পায় কোথায় এবং তার অভিমত অনুযায়ী কোন বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই তিনি ফেসবুকে কোন নেতিবাচক মন্তব্য লিখে ফেললো। আর তাতেই কি আমরা কোন চিন্তা ভাবনা না করেই তা অবিরাম শেয়ার করে যাবো!

কোন কিছুর সঠিক কারণ অনুসন্ধান একটি পরিশ্রমের কাজ, যা মানুষ সাধারণত করতে চায় না। এর চেয়ে গতানুগতিক ধারার ভেসে বেড়াতে মানুষ বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কারণ অনুসন্ধানের জন্য যে পথে গমন করতে হয় সেই পথকে মানুষের বড় দুর্বোধ্য প্রতিপন্ন হয়।

সুলতান ডাইনসের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হতে পারে, খাবারের মান খারাপ হতে পারে, আরো অনান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ও খারাপ হতেই পারে কিন্তু মাংসের কোন প্রকার ল্যাব টেস্ট ছাড়া তা কুকুর বা বিড়ালের মাংস বলে জনমনে যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করা হয়েছে তা অবস্যই একপ্রকার অপরাপ যা আমাদের সমাজে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হতে পারে।

আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা " ফুড ফোবিয়ায়" আক্রান্ত এবং আমাদের সমাজে আরো অনেক মানুষ আছে যারা প্রচলিত প্রাণীর মাংস বাদে অন্য অনেক অপ্রচলিত প্রাণীর মাংস খাওয়াকে একাধারে, পাপ, ঘৃণা, ও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে। তাহলে একবার ভেবে দেখুন তো তাদের মানসিক অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে।

আমাদের ফেসবুকে কোন কিছু শেয়ার করার আগে অবশ্যই ভাবা উচিৎ তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে। আমরা কোন কিছুই চোখ বন্ধ করে শেয়ার করতে পারি না কারন আমাদের দেশে এমন কিছু মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে যারা আসলে খুব সরল ভাবেই সব কিছুই বিশ্বাস করতে প্রস্তুত তারা মূলত ফেসবুককে "রোমানাস পন্টিফেক্সের" মতই বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড় করিয়েছে। যার কারনে ফেসবুক তাদের সামনে যেই তথ্য হাজির করে তারা তাই "রোমানাস পন্টিফেক্সের " স্থবির বিশ্বাস থেকে বিশ্বাস করে ফেলে এবং তা শেয়ার করে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে সেই তথ্য ছড়িয়ে পরে সমগ্র ভার্চুয়াল জগতে।

আমরা যে বিবেচনাহীন অন্ধবিশ্বাস থেকে উৎপন্ন ফেসবুক শেয়ারিং এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছি তা আমাদের বর্তমান ও আগামী সময়ের জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। আমাদের যে তরুণ প্রজন্ম রয়েছে তারা একটি ভাবলেশহীন চেতনার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠছে যা ভবিষ্যৎ পৃথিবী তথা বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সে কারণে এখনই সময় এই স্থবির অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার। কোন বিষয় সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করার আগে অবশ্যই তার সত্যতা, তার উপযোগিতা তার সামগ্রিক কল্যান বিবেচনা করে শেয়ার করতে হবে।

পৃথিবীতে সামাজিক উন্নতির মূল হিসেবে যাকে বিবেচনা করা হয় তা হচ্ছে মানুষের চিন্তার জগৎ কে পজিটিভ দিকে ধাবিত করে কর্মদক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা। একজন পজিটিভ মানুষ হাজার জন নেতিবাচক মানুষের চেয়ে সমাজের মূল কাঠামোর উন্নতির ক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা রাখতে সমর্থ। আমরা যদি আমাদের চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারি তাহলে কখনোই আমাদের জাগতিক মুক্তি সম্ভব নয়।

লেখক পরিচিতি: কাজী বনফুল, লেখক ও কলামিস্ট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App