×

মুক্তচিন্তা

লংমার্চের বাংলাদেশ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৩, ০১:২৬ এএম

আমার একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। আমার জন্ম ও আমার প্রিয় দেশ বাংলাদেশের জন্ম একই দিনে। ২৬ মার্চ। কিন্তু আমার জন্মের ঘোষণা চিকিৎসকের পূর্বলিখিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সেভাবে পূর্বঘোষিত নয়। অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলে চিহ্নিত করলেও তা খুব স্পষ্ট ও সরাসরি ছিল না। কেননা সেই সময় ও তার পরেও পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে শাসকদের সঙ্গে আলোচনা চলেছিল। কিন্তু শাসকরা বুঝে গিয়েছিল যে হয় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে অথবা বাঙালি দমনযজ্ঞে নামতে হবে। মনে মনে তারা দ্বিতীয়টা বেছে নিয়েছিল বলেই ক্রমাগত পশ্চিম থেকে পূর্বে সেনা আনার কাজটি নিঃশব্দে সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান শেষ চেষ্টা করেছিলেন যাতে আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়। কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে একবার স্বাধীনতার ঘোষণা সরাসরি করে দিলে সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়বে নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর এবং বিশ্ব গণমাধ্যম পাকিস্তান ভাঙার জন্য তাকে দায়ী করবে। এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা আগে না করে আলোচনা চালিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপ নিয়ে অনেকে উল্টো কথা বললেও এবং ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে তার সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা আজ প্রমাণিত। এই ধৈর্যের অগ্নিপরীক্ষায় তিনি সসম্মানে যে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তার প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল যতই নিরঙ্কুশ সমর্থন পান না কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তান ভাঙার দায় বঙ্গবন্ধুকে নিতে হতো। শুধু তাই নয়, সেই সময় ভারতবিরোধী অখণ্ড পাকিস্তানপন্থিদের সংখ্যা অবশ্যই বেশি ছিল। কাজেই এই রাজনীতির দাবাখেলায় সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের চালকের আসনে বসাতে দ্বিধা করতেন না তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের আমজনতা। কারণ তখনো পশ্চিমা শাসকদের নৃশংসতা ও ভারতের বন্ধুসুলভ সাহায্যের কোনো নিদর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের আগে পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ ভারতবিদ্বেষী ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয় পাকিস্তান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের নাম ছিল ‘পূর্ব বাংলা’। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলার নতুন নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অভিঘাতে এই সিদ্ধান্ত। এই প্রসঙ্গে একটা কথা সত্যি যে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল বাঙালি মুসলমানদের। ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাব এনেছিলেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। নেতৃত্বে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি ১৯৪৬ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন করেন। যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ সালে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদান করেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের ব্যাপারে কেবিনেট মিশন প্ল্যানের বিরুদ্ধে জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের আগস্টের ১৬ তারিখে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন। মুসলমানদের জন্য আলাদা বাসভূমি পাকিস্তানের দাবিতে এই দিন মুসলমানরা বিক্ষোভ করলে কলকাতায় ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেধে যায়। তার উদ্যোগে ১৯৪৬ সালে দিল্লি সম্মেলনে মুসলিম লীগের আইনপ্রণেতাদের কাছে লাহোর প্রস্তাবের একটি বিতর্কিত সংশোধনী পেশ করা হয়। এই সংশোধনীতে অখণ্ড স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবনা ছিল। শেখ মুজিব এদের প্রত্যক্ষ সাহচর্যে পরিণত রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন। তিনি খুব ভালো করে বুঝতে পারেন যে বাঙালিদের জন্য যে পাকিস্তানের স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন তা কিছুতেই সফল হবে না। কারণ পাকিস্তান প্রস্তাবে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল- ‘নর্থ ওয়েস্টার্ন এন্ড ইস্টার্ন জোন অব ইন্ডিয়া শ্যুড বি গ্রুপড টু কনস্টিটিউট ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস’, মানে হলো- দুই প্রান্তে দুটি দেশ। পরে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বললেন যে প্রস্তাব পড়া হয়েছে তাতে টাইপের ভুলে স্টেটস লেখা ছিল। কিন্তু সেটা হবে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’, মানে একটাই পাকিস্তান হবে দুই প্রান্তে। বাঙালির মাথায় ছড়ি ঘোরাবে জিন্নাহ। তাই হলো। পশ্চিমা শাসকরা পূর্ব বাংলাকে ক্রমে উপনিবেশে পরিণত করল। এই পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান নাম বদলের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ অধিবেশনে তিনি সংসদে স্পিকারকে বললেন, ‘স্যার আপনি দেখবেন, ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার বলেছি, আপনারা এ দেশটাকে বাংলা নামে ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম পরিবর্তন করতে চাইলে আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।’ ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ রুজু করে এই অভিযোগে যে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে চাইছেন। প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন কতগুলো চিরকুট, যাতে লেখা ‘বাংলাদেশ’। পাকিস্তান সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে বাঙালিদের স্বাধীনতা লাভের অভীপ্সাকে সন্দেহ করে। কিন্তু সত্যি কি বাঙালিরা তখন পাকিস্তান ভেঙে নতুন রাষ্ট্র চেয়েছিল। একেবারেই নয়। তারা চেয়েছিল আত্মমর্যাদা, তারা চেয়েছিল ভাষার সম্মান, তারা চেয়েছিল সম্পদের সমবণ্টন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ধর্মীয় সুড়সুড়ি ও ভারতবিরোধী বাষ্প ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানকে কিছুই দেয়নি। যা দিয়েছে তা হলো লাঠি, গুলি, অপমান ও শোষণ। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবসে আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, আর পূর্ব পাকিস্তান নয়, আর পূর্ব বাংলা নয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি- আজ থেকে বাঙালি জাতির এই আবাসভূমির নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন তার ছিল এবং সেটাই ছিল তার দাবি। কিন্তু ২৫ মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু বুঝে যান যে সেনানিপীড়ন নেমে আসছে। তিনি প্রকৃত নেতার মতো একের পর এক নির্দেশনা দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন কখন পাকিস্তানি সেনাদের খাঁড়া তার ওপর নেমে আসবে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হতেই ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা বার্তা এসেছিল ঢাকার মগবাজার টিএন্ডটি অফিসের মাহতাব উদ্দীনের কাছে। মাহতাব উদ্দীন ২৬ মার্চ ভোর ৬টায় ওয়্যারলেসযোগে চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি টেলিগ্রাফ স্টেশনে পাঠান। যা রিসিভ করেন চট্টগ্রাম অফিসের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল কাদের। তারপর এই মেসেজটি লিফলেট আকারে চট্টগ্রামে প্রচার করা হয়। এই লিফলেটই তখনকার চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নানের কাছেও পৌঁছায় এবং তিনি ২৬ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম রেডিও থেকে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণাটি প্রথম পাঠ করেন। সেটাই ছিল বাংলাদেশের অফিসিয়াল স্বাধীনতার ঘোষণা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা ইপিআরের সিগন্যাল সেন্টারের কর্মীদের পাঠানো হয়। শহীদ সুবেদার মেজর শওকত আলীর নেতৃত্বে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ রাতে প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আসলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যান্য ছোট ছোট দেশের স্বাধীনতার প্রতীক করে তুলেছেন। যেমন জাতীয় ক্ষেত্রে, তেমন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ দুটি সম্পূরক শব্দ। সৈয়দ আবদুস সামাদ বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের মানুষ ছিলেন। একবার তিনি বলেছিলেন, ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে বেশ কিছু ছোট রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তার আগে সেই সব রাষ্ট্রের কিছু নেতার সঙ্গে সামাদ সাহেবের সাক্ষাৎ হয়। তারা সামাদ সাহেবকে বলেন, ‘আমরা সোভিয়েতবাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করেছি। ওই ছোট্ট দেশটি স্বাধীন হতে পারলে আমরা পারব না কেন?’ সামাদ সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘স্বাধীনতা কীভাবে অর্জিত হবে বলে মনে করেন?’ তার উত্তর ‘যেভাবে আপনারা পেয়েছেন। তবে আমাদের শেখ মুজিবের মতো দৃঢ় ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্বাধীনতার ডাক দিতে হবে।’ বোঝা যাচ্ছে যে স্বাধীনতার আহ্বানের অন্যতম প্রতীক হয়ে আজো বঙ্গবন্ধু সারা বিশ্বে বিদ্যমান। এখানেই গুরুত্ব ২৬ মার্চের। এখানেই বঙ্গবন্ধু পার্থিব হিসাবের অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করছেন এবং বঙ্গবন্ধু যে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তা অবশ্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষণার লোভনীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App