×

জাতীয়

তিস্তায় পশ্চিমবঙ্গের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, উৎকণ্ঠায় ঢাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৩, ১০:৪৪ এএম

তিস্তায় পশ্চিমবঙ্গের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, উৎকণ্ঠায় ঢাকা

ছবি: সংগৃহীত

জানার পর মন্তব্য করবেন পানিসম্পদ সচিব

‘তিস্তা থেকে বাংলাদেশকে জল দেব না’-কথাটিই যেন কার্যকর করতে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। গত ১১ বছর ধরে যেখানে বাংলাদেশ তিস্তা থেকে পানির ভাগভাগি চুক্তি করতে বসে আছে সেখানে এতদিন পশ্চিমবঙ্গ বলে আসছে, তিস্তায় পানিই নেই। অথচ সেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে কলকাতার দৈনিক টেলিগ্রাফ খবর প্রকাশ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের এ পদক্ষেপ ঢাকা তথা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। কারণ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান ভোরের কাগজকে বলেছেন, তিস্তায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের খবরটি বাংলাদেশ সরকার এখনো জানে না। পুরোপুরি জেনে তিনি প্রতিক্রিয়া জানাবেন। এর আগে গত সোমবার ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিকল্পিত তিনটি ‘দার্জিলিং প্রজেক্টে’র মধ্যে দুটি তিস্তায় সেচের পানির পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে, আর সেটিও এমন এক সময় যখন (ডিসেম্বর-এপ্রিল শুষ্ক মৌসুমে) বাংলাদেশে সেচের পানির চাহিদা বেড়ে যায়। একটি সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তা লো ড্যাম প্রজেক্ট (টিএলডিপি)-এর ১ ও ২ প্রকল্পের ওপর বিশদ প্রতিবেদন (ডিপিআর) তৈরির জন্য নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।

তিস্তা নদীর উপনদী বড় রংগীত নদীর ওপরে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া এই দুই প্রকল্পে ৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্মিলিত ক্ষমতা থাকবে। এছাড়া বালাসন ও রংভাং নদীর ওপর বালাসন হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্টের ডিপিআরের জন্য অনুরূপ অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলেও সূত্রটি উল্লেখ করেছে। আর এই প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৮ মেগাওয়াট। ওই সূত্রটি বলেছে, অন্যান্য আরো ১০টি ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কিত ডিপিআর প্রস্তুত করার জন্যও নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবসম্মত কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। এর মধ্যে টিএলডিপি ১ ও টিএলডিপি ২ প্রকল্প নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারণ এ দুটি প্রকল্প বড় রংগীত নদীর ওপরে বাস্তবায়ন করা হবে আর এই নদীটি তিস্তার যে অংশ বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে সেই অংশের সঙ্গে যুক্ত। আন্তর্জাতিক নদী হওয়ায় তিস্তার পানিতে ঢাকার অধিকার আছে।

এই নদীর পানির ন্যায্য পাওনা নিশ্চিতে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা থাকলেও সেসময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। মমতা তখন যুক্তি দিয়েছিলেন, তিস্তায় উভয় দেশের সেচের চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত পানির অভাব রয়েছে, বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে। দীর্ঘ এক দশকেও তিস্তা চুক্তি আলোর মুখ না দেখায় সা¤প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা বারবার দিল্লিকে নিজের অস্বস্তির কথা জানিয়েছে। কিন্তু দিল্লি ও কলকাতার সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। অন্যদিকে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের অধীনে দুটি খাল খননের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের সেচ বিভাগের পরিকল্পনা প্রকাশ্যে আসার পর ঢাকার ক্ষত আরো গভীর হয়েছে।

বাংলাদেশের সূত্রের বরাতে ওই প্রতিবেদনে দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, চলতি বছরের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে বিষয়টি দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় আসতে পারে। আর এই পরিস্থিতিতে সিকিমের ১১টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরও পশ্চিমবঙ্গের পরিকল্পিত এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ঢাকার জন্য আরেকটি খারাপ সংবাদ হিসেবে এসেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই বছরের শেষের দিকে বা আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

কিন্তু তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে ব্যর্থতা নিজ দেশে ক্ষমতাসীনদের জন্য সমস্যা আরো বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করে টেলিগ্রাফ। ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যমটি বলছে, বাংলাদেশে পানি একটি আবেগপূর্ণ বিষয়। যদিও পরিকল্পিত জলবিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর সবগুলোই রান-অব-দ্য-রিভার প্রকল্প, যার অর্থ জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য নেয়া পানি আবার নদীতেই ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু একজন নদী বিশেষজ্ঞ বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত পানি সেচের জন্য পাওয়া যাবে না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ওই সূত্রটি জানিয়েছে, এই ধরনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য দিনের বেলা নদী থেকে পানি টেনে নেয়া হয় এবং সন্ধ্যায় যখন বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ অবস্থায় থাকে তখন তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। আর গভীর রাতে সেই পানি ফের নদীতে ফেরত দেয়া হয়, কিন্তু সে সময় সেচের জন্য পানির চাহিদা খুব কমই থাকে। টেলিগ্রাফ বলছে, তিস্তার পানির কম পরিমাণ এবং এর ফলে উর্বর পলির প্রবাহ হ্রাসের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিশাল অংশ শুষ্ক ভূমিতে পরিণত হয়েছে, যা চাষের জন্য অনুপযুক্ত।

বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছে, আমরা তিস্তা ইস্যুকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রাখতে পারি না, কারণ পানির ওপর আমাদের ন্যায্য দাবি রয়েছে এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো- এখানে নদীর জীবনের প্রশ্নও জড়িত। ভারতীয় নদী বিশেষজ্ঞরাও বিশ্বাস করেন, তিস্তাকে সেচ ও জ্বালানি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করার ওপর অত্যধিক জোর দেয়া হলে তা নদীটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ভারতীয় সেচের চাহিদা মেটানোর কথা বলে দুটি খাল খননের যে যৌক্তিকতা স¤প্রতি তুলে ধরা হয়েছে তাকে অতিরঞ্জিত বলেও উল্লেখ করেন তিনি। একটি সূত্র বলেছে, নদীর নিচে জমে থাকা পলি স্থানান্তরের জন্য সেখানে উল্লেখযোগ্য পানি প্রবাহ প্রয়োজন। এমনকি জীববৈচিত্র্যের জন্যও এই পানি প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেচ এবং বিদ্যুতের জন্য নদী ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায়শই এই দুই ইতিবাচক দিক ভুলে যায় অনেকে।

ভারতের একজন নদী বিশেষজ্ঞ বলছেন, এটা মনে রাখেতে হবে, পূর্বাঞ্চলীয় হিমালয় অস্থিতিশীল এবং খুব বেশি বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্যযুক্ত এলাকা। আর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প মানে আরো বেশি বন উজাড় করা এবং ব্লাস্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে টানেল তৈরি করা। আমি মনে করি, প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করার একটা সীমা আছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের যুক্তি, তাপবিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমাতে জলবিদ্যুতের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। রাজ্যটির একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিটি রাজ্যে জলবিদ্যুৎ ক্রয়ের বাধ্যবাধকতা এবং সবুজ-বিদ্যুৎ-উৎপাদনের (নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন) আদেশ রয়েছে। এগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App