×

জাতীয়

কুনিপাড়া বস্তিতে মরণফাঁদ টিনের ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ বাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৩, ০৯:৪৫ এএম

কুনিপাড়া বস্তিতে মরণফাঁদ টিনের ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ বাস

ছবি: ভোরের কাগজ

গ্যাস লিকেজে প্রায়ই আগুন লাগে

রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের কুনিপাড়া এলাকা, রোলিং মিলের পাশে বটতলা ধরে সরু রাস্তা দিয়ে সামনে এগোলে হাজী শামসুদ্দিন লেন। এই লেনের দুপাশ দিয়ে ভবনের আদলে ছাদ করে লোহার পাটাতন আর টিন দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল দোতলা-তিন তলা বাড়ি। এটি রোলিং মিল বস্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে ৫০-১০০টি ঘর। কিন্তু সরু রাস্তা, ঘিঞ্জি ঘর, অপরিকল্পিত গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনের কারণে প্রতিটি বাড়িই যেন মৃত্যুকূপ। এখানেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন স্বল্প আয়ের মানুষরা। টিন দিয়ে ঘেরা ছোট ঘরগুলোতে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন সাজানো সংসার। গত সোমবার রাতের ভয়াবহ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে সেখানে বসবাস করা ২ শতাধিক পরিবারের স্বপ্ন।

আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ৬টি বাড়ির কমপক্ষে ৩ শতাধিক ঘর। তিন তলা দুটি বাড়ির এমন অবস্থা হয়েছে যে, পোড়া টিন আর অঙ্গার হওয়া আসবাবপত্র না থাকলে বোঝাই যেত না সেখানে কোনো বাড়ি ছিল। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরজমিনে রোলিং মিল বস্তিতে গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়।

এদিকে, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বাড়িগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সেখানে দেয়া হয়েছে তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ওয়াসার বৈধ লাইন। বাসিন্দারা বলছেন, গ্যাসের বৈধ লাইন হলেও প্রায় চুলার লিকেজ থেকে ছোট ছোট আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। যে টিনের ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেটির দোতলায় কিছুদিন আগেই গ্যাসের চুলায় আগুন লেগেছিল। যদিও সোমবার রাতে শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে দাবি করেন তারা।

বস্তিটিতে ২৫ বছর ধরে বসবাস করা মুদি দোকানদার মো. ফারুক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, জায়গাটিতে একসময় ঝিল থাকলেও ধীরে ধীরে এই বাড়ি-ঘর গড়ে ওঠে। এখানকার বেশিরভাগ জায়গার মালিক ছিলেন প্রয়াত হাজী শামসুদ্দিন, তার নামে এই লেনের নামকরণ করা হয়েছে। অনেকে তাদের কাছ থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে বা কিনে নিয়ে বাড়ি করেছেন।

ফারুক হোসেন বলেন, সোমবার রাত ৮টার দিকে হাজী শামসুদ্দিনের মেজো ছেলে মৃত শরীফ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হালিমার ৩ তলা ভবনের ২য় তলার ৩ নম্বর ঘর থেকে আগুন লাগে। এরপর মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আগুন লাগার কিছু সময় পর ফায়ার সার্ভিস এলেও, সরু রাস্তার কারণে তারা ভেতরে আসতে পারেনি। একটি ইউনিট কাজ শুরু করলেও কিছুক্ষণ পর জানায় পানি শেষ। এতে আগুন আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ে। হালিমার বাড়ির নিচ তলায় থাকা সেলুনের নাপিত মো. আলী বলেন, হুট করেই ‘আগুন আগুন’ চিৎকার শুনতে পাই। তখন সবাই জীবন বাঁচাতে দৌড়ে বেরিয়ে যায়।

৪টি বাড়ির ২ শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে আক্কাস আলীর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে ছিলাম। এসে দেখি সব শেষ। এক প্রশ্নের জবাবে আক্কাস আলী বলেন, কোনো বাড়িতেই অবৈধ কোনো লাইন নেই। সবকিছুই আমরা বৈধভাবে নিয়েছি। নিয়মিত বিলও পরিশোধ করে আসছি। অগ্নিকাণ্ডের পরে ঘটনাস্থলে বিভিন্ন রঙের কৌটা ও কেমিক্যালের ছোট ড্রাম দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের রোভার স্কাউট গ্রুপের সদস্য মো. মুহিবুল্লাহ।

অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেইন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যানজটের কারণে আমাদের পৌঁছতে কিছুটা দেরি হয়। এছাড়া পার্কিং ও সরু রাস্তাসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। এরপরও বিকল্প পানির উৎস খুঁজে ১১টি ইউনিটের ২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কী কারণে আগুন লেগেছে সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলেনি ফায়ার সার্ভিস।

থামছে না সর্বহারাদের কান্না : অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সর্বস্ব হারানো বস্তিবাসীদের গতকালও যার যার ঘরের সামনে বসে বিলাপ করতে দেখা যায়। আবার অনেককে ছাঁইয়ের মধ্যে অবশিষ্ট কিছু আছে কিনা সেই খোঁজ করতে দেখা গেছে।

পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে বসে বিলাপ করছিলেন নুরজাহান বেগম নামের এক বৃদ্ধা। তিনি বলেন, ছেঁড়া কাপড়ে কাজে গেছিলাম, এসে দেখি বাসার সব পুড়ে গেছে। পড়নের কাপড় ছাড়া কিছু অবশিষ্ট নাই। রাস্তার ফকির হয়ে গেলাম। তিনি বলেন, স্বামী নাই। ৬ মাস হলো, ছেলেটা বউ ও ২ ছেলেকে রেখে কোথায় যেন চলে গেছে। পিঠার দোকান করে সংসার চালাই। সামনে রোজার মাস পিঠা চলবে না। এজন্য অনেক কষ্ট করে চাল-ডাল কিনে রাখছিলাম। সব শেষ আমার। এখন থেকে রাস্তায় থাকা লাগবে।

শুধু নূরজাহান বেগমই নয়, অগ্নিকাণ্ডে সব খুইয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন শত শত মানুষ। বস্তিতে নিজের টেইলার্সের থাকা সেলাই মেশিন দেখিয়ে রাহাত হোসেন বলেন, ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার। ৫টি সেলাই মেশিন ছিল। এখন লোহার ফ্রেম ছাড়া কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। মানুষে নিয়ে গেছে। আর কাপড়ের পিস সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হওয়া হালিমার বাড়ির ২য় তলার বাসিন্দা এক দিনমজুর বলেন, তিলে তিলে গড়ে তোলা ফ্রিজ, আলমারি খাটসহ সব পুড়ে গেছে। একবেলা খাব… সেই উপায় আমাদের নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্যাস লিকেজ থেকে প্রায়ই আগুন লাগত। আমি নিজেই একবার গ্যাসের চুলা জ¦ালাতে গিয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। তবুও কম ভাড়ার জন্য ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করতে হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App