×

মুক্তচিন্তা

ভোঁতা মনন, মগজহীন মাথা ও অগ্রযাত্রার গল্প

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৩, ০৩:০৬ এএম

ভোঁতা মনন, মগজহীন মাথা ও অগ্রযাত্রার গল্প
১১ কোটি টাকার ঘটনাটিও দেশে উত্তেজনা তৈরি করতে পারেনি। রাজধানীর উত্তরার তুরাগ এলাকায় এক সকালে বেসরকারি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের (ডিবিবিএল) একটি গাড়ি থেকে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা লুট করে ডাকাতরা। পরে দিনভর অভিযান চালিয়ে লা মেরিডিয়ান হোটেলের আশপাশের এলাকা থেকে ডাকাতি হওয়া টাকাভর্তি তিনটি ট্রাংক উদ্ধার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সর্বশেষ তথ্য পাওয়া পর্যন্ত উদ্ধারকৃত টাকা গোনা হয়নি। তবে অনুমান করা হচ্ছে, উদ্ধারকৃত অর্থের পরিমাণ ৯ কোটি টাকা। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্যাংকের অর্থ লুটের এটিই সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর আগে গত কয়েক বছর ঢাকায় ব্যাংকের অর্থ লুটের কয়েকটি ঘটনা ঘটলেও সেগুলোয় অর্থের পরিমাণ ছিল তুলনামূলক কম। এরপরও আমরা সহজেই তা ভুলে গেছি। দু-একটা বুদবুদের মতো উত্তেজনাও উঠেই ডুবে গেছে। কারণ এখন ১১ কোটি তেমন কোনো ব্যাপার না। আমরা যখন যৌবনের শেষপ্রান্তে তখন ব্যাংক থেকে এক কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল এক হিন্দু কর্মকর্তা। সে এক বিশাল নিউজ। মিডিয়া ছিল হাতেগোনা। কিন্তু মানুষ ছিল সচেতন আর উদ্বিগ্ন। সে ঘটনার জেরে বহু সাধারণ মানুষেরও ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। এখন মিডিয়া অজস্র খবরের মাধ্যম। কিন্তু উত্তেজনা উধাও। যে দেশে বালিশ কাণ্ড দরজা কাণ্ড ওষুধ কাণ্ডে কোটি কোটি টাকার খবর রটে, উধাও হয়ে যায় হাজার হাজার কোটি টাকা সে সমাজে ১১ কোটি কি বড় বিষয়? বড় যে না তার প্রমাণ এই ঘটনার জেরে নিশ্চুপ জনমত। অথবা জনমত কি বলছে তা জানার কোনো উপায় নেই আর। আচ্ছা কেন নেই? গণতন্ত্র না কি প্রবহমান। মানুষ জানছে বেশি শুনছে বেশি। তারপরও কেন এই নীরবতা বা অচলায়তন? ঢাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সিদ্দিকবাজরের এই অগ্নিকাণ্ড আমাদের কী বার্তা দিয়ে গেল? আমরা সবাই দেখলাম আহত মানুষের আহাজারি নিহতদের নির্বাক লাশ আর স্বজনদের কান্না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এরপরও আমাদের টনকে টান পড়েনি সেভাবে। মানুষ আহা উহু করেছে অবশ্যই কিন্তু হয় বেদনা জমাট বাঁধে না আর অথবা অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে জনগণের হৃদয়। মেয়র সাহেবও যাননি যতদূর জানি। হয়তো তিনি অন্যভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কিন্তু মানুষের সন্তুষ্টি ও আশার জন্য মানুষের ভরসার জন্য মেয়রের থাকাটা ছিল জরুরি। এ ঘটনার এখনো কোনো কারণ বের করা সম্ভব হয়নি। তবে নিরাশ হবেন না। তারা বলছে তদন্ত চলছে। তদন্ত যে কী বিষয় তা আমাদের কারো অজানা কিছু নয়। তদন্ত হবে রিপোর্ট হবে রিপোর্ট দিতে সময় লাগবে। সে সময়ের ফাঁকে মানুষ এসব ভুলে যাবে। কেন ভুলবে? কারণ খোদা না করুন এর ভেতরেই হয়তো আরেকটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাবে। অথবা এমন কোনো কাণ্ড ঘটবে যার ধামাকায় আজ এই নির্ভরতার জায়গাটি ঢাকা পড়ে যাবে এই অগ্নিকাণ্ড। এই যে ঘটনাগুলো এগুলো সব দেশেই কমবেশি ঘটে। পার্থক্য হলো আমাদের দেশে একসময় এগুলো মানুষকে প্রভাবিত করত। জনমত তৈরি হতো। মানুষ রুখে দাঁড়াতে জানত বলে এসব ঘটনার নেপথ্যে থাকা মানুষ সাবধান হতো। সাধারণ জনগণ নিশ্চিত হতো। সেই জায়গার নাম নির্ভরতা। আজ এই নির্ভরতার জায়গাটুকু টলমলে। টালমাটাল বাংলাদেশের এই বাস্তবতা উন্নয়নের সঙ্গে যায় না। এটা তো নিশ্চিত যে উন্নয়ন হচ্ছে। মানুষের হাতে টাকা এসেছে। আবার এটাও সত্য বাজারে আগুন। বিশ্বের বহু দেশের এখন অভাব অনটন নিত্যসঙ্গী। হাঁফিয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষ। চড়া দামের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও এখন কঠিন। সে তুলনায় বাংলাদেশ একটু ভালো আছে। সে ভালো কতটা ভালো আর নির্ভরতার সেটাই প্রশ্ন। কারণ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের অবস্থা শাঁখের করাতের মতো রাশিয়াকে রাগানো যেমন অসম্ভব তেমনি আমেরিকার রোষানলে পড়াটাও হবে অবিবেচকের কাজ। প্রশ্ন হলো ভারত যেভাবে গা ঝেরে সিদ্ধান্ত নিয়ে তেলের ব্যাপারে দুশ্চিন্তামুক্ত আমরা কেন তা পারলাম না? কারণ আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত মতো আর রাজনীতি। পররাষ্ট্রনীতি সঠিক কিন্তু মন্ত্রী যখন কথা বলেন তখন দ্বিধাগ্রস্ত হতে হয়। তার কথায় যোগসূত্র থাকে কম। মনে হয় সে সময়ের কোনো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করেই অবতারণা হচ্ছে আলাপ। অথচ নীতি সঠিক বলে মেরুদণ্ড সোজা রেখে সিদ্বান্ত নেয়া যেত। তাহলে হয়তো জনগণের ওপর মূল্যবৃদ্ধির যে চাপ তা সহনীয় পর্যায়ে থাকত। কিন্তু ওই যে বললাম অভাব অনটন বা মানুষের কষ্টের ভার লাঘব না করলেও সাময়িক ভুলিয়ে দেয় অঘটন। যেমন ঢাকার সুলতান ডাইনসে কুকুরের মাংসের ঘটনা। একটা কথা বলি কুকুরের মাংস কোনো অখাদ্য কিছু না। বরং বহু দেশের মানুষ তা ভালোবেসে খায়। তাদের আনন্দের খাবার কুকুরের মাংস। দেশ ও সমাজ ভেদে এটি নিষিদ্ধ বা অপ্রচলিত। তাছাড়া যেসব কুকুরের মাংস খাওয়া হবে তাদের শরীর স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্ন। সে দিক থেকে সুলতান ডাইনসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য হলে তা ভয়াবহ। আমার জিজ্ঞাসা এমন কঠিন অভিযোগ সত্য কি না তা প্রমাণিত হওয়ার আগেই এমন ফলাও করে টিভিগুলো প্রচার করে কীভাবে? আমি তো এমনও দেখলাম পুরো বিষয়টি ভিডিও করে প্রচার করা হচ্ছিল জাতীয় একটি মিডিয়ায়। এটা কি সুস্থ সাংবাদিকতা? না প্রাইভেসি আইনে তা অনুমোদিত? এদেশে সব সম্ভব। কুকুরের মাংস খাওয়ানো যেমন সম্ভব তেমনি মিথ্যা অজুহাতে কারো ব্যবসা পথে বসিয়ে দেয়াও সম্ভব। এর কারণও জনমনে সঠিক তথ্যের অভাব। মানুষ কখন গুজব ও অসত্যকে সমর্থন করে? পছন্দ করে? যখন তার সামনে থেকে সত্য উধাও হয়ে যায়। যখন তার বোধগম্য নাকি হচ্ছে, কেন হচ্ছে? তখন তার একটাই পথ। আরো বেশি করে যখন যুগটাই ডিজিটাল। এই ডিজিটাল যুগে হিরো আলম নেতা। বাদাম কাকু গায়ক। কুকুরের মাংস ভাইরাল। ভাইরাল মানুষের কু ইচ্ছা। ঢাকার সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের সময় আহত এবং ভুক্তভোগীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন মানুষজন জড়ো হয়ে দুর্ঘটনা ভিডিও করে লাইভ দিতে ব্যস্ত থাকলেও সাহায্য করতে এগিয়ে যায়নি। কাজেই মানুষকে ধোয়া তুলসী পাতা ভাবারও কারণ নেই। মোদ্দা ব্যাপার আমরা যারা দেশ ও দেশের বাইরে থেকে চিন্তা করি কিংবা ভাবি আমাদের মনে হয় এক অদ্ভুত সমাজ গড়ে উঠেছে দেশে। যার অনুভবা বিলীন। যার আত্মা নেই। যাদের মন থাকলেও মনন নেই। যাদের মাথা আছে কিন্তু মগজ নেই। এই অপপ্রক্রিয়ার হোতা রাজনীতি। তারপর ক্রমেই তা হয়ে গেছে অভ্যাস। এই জনগোষ্ঠীকে যদি গণতান্ত্রিক মেধাবী আর মননশীল করে তোলা না যায় কিংবা সংবেদনশীল করে তোলা না হয় তারা কি পারবে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বা আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে? পারবে না। অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App