×

সারাদেশ

শাল্লায় ৫ বছরেই কোটিপতি এসও’র ড্রাইভার!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৩, ০৭:২৮ পিএম

শাল্লায় ৫ বছরেই কোটিপতি এসও’র ড্রাইভার!

ছবি: ভোরের কাগজ

একটা লুঙ্গি ছিঁড়ে গেলে আর একটা লুঙ্গি কেনার সামর্থ্য ছিল না সহিনুর মিয়ার। ৯ বছর পূর্বে জীবিকা নির্বাহের জন্য ভাঙাচোরা একটি মোটরসাইকেল কিনেন সহিনুর মিয়া। সেই মোটরসাইকেলে করে নেশাখোর মানুষদের নিয়ে যেতো শাল্লা ইউপির কুখ্যাত চোরের গ্রাম কামারগাঁও গ্রামে। কারণ সেখানেই উৎপাদন হতো চোলাই মদ। অবশ্য প্রশাসনের কঠোর ভূমিকায় এখন আর ওই গ্রামে চৌর্যবৃত্তি পেশা ও চোলাই মদ উৎপাদন করে না কামারগাঁও গ্রামের মানুষ।

সে সময় নেশাখোর মানুষদের মোটরসাইকেলে যাতায়াতের জন্য ভাড়া মিলত মাত্র ৩০০ টাকা। কোনো কোনো সময় ৪০০ টাকাও আয় রোজগার হতো সহিনুরের। এসব কথা ২০১২ থেকে ২০১৩ সালের। এভাবেই দারিদ্রতার সাথে অনেকটা যুদ্ধ করে চলতো সহিনুর মিয়ার সংসার। সহিনুর মিয়া এখন কোটিপতি। এ যেনো আলাদীনের চেরাগের গল্পের মতোই। সহিনুর মিয়া শাল্লা ইউপির ইছাকপুর গ্রামের ইসলাম নূরের ছেলে।

২০১৭ সালে সুনামগঞ্জ জেলার সবকটি হাওরের বোরো ফসল ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে সরকার। প্রণয়ন করা হয় সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা ২০১৭।

নীতিমালা অনুযায়ী হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের দায়িত্ব পান এলাকার স্থানীয় কৃষকরা। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে ১৮৩টি বাঁধের ভাঙা বন্ধকরণ ও মেরামতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৩৪ কোটি টাকা। বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব নিয়ে শাল্লায় অবস্থান করেন তৎকালীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা কর্মকর্তা শমশের আলী মন্টু। এসও শমশের আলী মন্টু মোটরসাইকেল ড্রাইভার হিসেবে ব্যবহার করেন সহিনুর মিয়াকে।

মূলত তখন থেকেই ধীরেধীরে ভাগ্য বদল হতে থাকে সহিনুরের। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরই সহিনুরকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। কৃষকদেরকে পিআইসি থেকে লাখ লাখ টাকা লাভবান হওয়ার লোভ দেখিয়ে প্রত্যেক পিআইসি কমিটির লোকজনদের নিকট থেকে অগ্রিম ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। বিনিময়ে বাঁধ মেরামতে প্রয়োজনের তুলনায় দেয়া হয় অতিরিক্ত বরাদ্দ।

পিআইসি অনুমোদনের পূর্বে সহিনুর মিয়াকে কৃষকরা দিতে হয় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। এমনই একটি ভিডিও এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে। এখানেই শেষ নয়, পিআইসি কমিটি বিল উত্তোলন করতেও শাখা কর্মকর্তাদের দিতে হয় ২০ ভাগ কমিশন। পিআইসি কমিটির লোকজন বিল উত্তোলন করেন মোট ৪টি কিস্তিতে। বিল তুলতে গিয়েও পিআইসি কমিটি গায়ের ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। ঘাটেঘাটে কৃষকদের দিতে হয় টাকা।

এসব কথা পিআইসিরা রাস্তা-ঘাটে কিংবা চায়ের দোকানে বসে আলোচনা করলেও মিডিয়ার সামনে কথা বলতে নারাজ তারা। সেখানে সহিনুরকেও দিতে হয় ২ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এই সিস্টেম চলতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে শাখা কর্মকর্তা শমশের আলী মন্টুর পদোন্নতি হলে বাপাউবোর শাল্লা শাখা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান আব্দুল কাইয়ুম। তখনও সিস্টেম একই, মোটরসাইকেল ড্রাইভারও সহিনুর মিয়া।

একেবারে অজপাড়া গ্রাম থেকে শাল্লা সদরের বাসিন্দা হয়ে যায় সহিনুর। সামান্য মোটরসাইকেল ড্রাইভার থেকে সহিনুর হয়ে যায় কোটি টাকার মালিক। শাল্লা সদরের বাসিন্দা উজ্জ্বল মিয়ার দ্বিতীয় তলা ৬ লাখ টাকায় বন্ধক রেখে শুরু করে বিলাসী জীবন।

এভাবেই সহিনুর মিয়া পিআইসি কমিটির লোকজনদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এক পর্যায়ে পিআইসিরা সহিনুর মিয়াকে দ্বিতীয় এসও বলতে শোনা যায়! স্থানীয়দের ভাষ্যমতে সহিনুর গত ৫ বছরে বিভিন্ন হাওরে প্রায় ৮ হেক্টর বোরো জমি বন্ধক রেখেছে, আবার অনেক জমি কিনেও ফেলেছে। শাল্লা সদরে প্রায় ৪০ লাখ টাকার একাধিক ভিটেমাটি বন্ধক রেখেছে। চড়া সুদে পিআইসিদের অগ্রিম টাকাও দেয় সহিনুর। এভাবেই সহিনুর মিয়া দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে।

সহিনুরের এতো অর্থের ঘটনা মিডিয়ায় জানাজানি হওয়ার আশঙ্কায় বছর খানেক আগে সহিনুরকে এসও’র মোটরসাইকেল ড্রাইভারের অস্থায়ীভাবে ভাড়ায় নেয়ার দায়িত্ব থেকে কৌশলে অব্যাহতি দেন আব্দুল কাইয়ুম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মোটরসাইকেল ড্রাইভার হিসেবে ভাড়ার চালানোর দায়িত্ব হারালেও, এসও আব্দুল কাইয়ুমের সাথে রয়েছে তার নিবিড় যোগাযোগ।

জানা যায়, সহিনুর মিয়াকে মোটরসাইকেল ড্রাইভার হিসেবে প্রতি মাসে পাউবোর শাখা অফিস থেকে দেয়া হতো ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। তাও তেল খরচ ড্রাইভারের। তাদেরকে মাসিক ভাড়ায় নেয়া হতো। জনমনে প্রশ্ন অন্যান্য মোটরসাইকেল ড্রাইভারদের যেখানে নুন আনতে পান্তা পুরোয়। সেখানে সহিনুরের মতো ড্রাইভার কোটিপতি হলো কী করে?

এ বিষয়ে শাল্লা সদরের বাসিন্দা সোহাগ মিয়া বলেন, সহিনুর তো পিআইসি নিয়া অনেক মারিং কাটিং করছে। সহিনুর আমার ছোট ভাই উজ্জ্বল মিয়ার বিল্ডিংয়ের দুতলা বন্ধক নিছে ৬ লাখ টাকায়। ঘুঙিয়ারগাঁও বাজারে অন্তত ৭টা ভিট বন্ধক আছে। এখানেই তো প্রায় ৪০ লাখ টাকা। ফয়েজুল্লাহপুর গ্রামের জমি কিনছে ১২ কেয়ার। ১৮ লাখ টাকা দামের একটি ট্রাক্টরও আছে সহিনুরের। সহিনুর কোটি টাকার মালিক। এইডা সত্য। এখন আমারে কয় মামু পিআইসি দিমু কইয়া ধরা খাইয়ালাইছি। আমারে ২ লাখ টাকা দেও। আমি কইছি তোমার তো সট হওয়ার কথা না। এখন তুমি যদি ইন্ডিয়া বা পাকিস্তানে টাকা পাঠাইয়া থাক, তাইকে হেইডা অন্য কথা। সহিনুর তো এর আগে কামারগাঁও নেশাখোরদের নিয়া যাইত মোটরসাইকেলে। দৈনিক ৩ থেকে ৪০০ টাকা। আমি তখন হেইখানে হাঁস পালতাম। আমার হাঁসের খামার আছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইছাকপুর গ্রামের এক কৃষক বলেন, ৪ বছর আগে সহিনুরের একটা লুঙ্গি ছিঁড়লে আরেকটা লুঙ্গি কেনার সামর্থ্য আছিল না। গত বছর ২৫ কেয়ার জমি কিনছে। যার মূল্য প্রায় ২৫ লাখ টাকা।

ঘুঙ্গিয়ারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা পলাশ সরকার পল্টু বলেন, এ বছর আমার ১২ শতাংশ জায়গা কিনছে সহিনুর ১৩ লাখ টাকা দিয়া।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে ফোনে সহিনুর মিয়ার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করলে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন সহিনুর মিয়া পলাতক রয়েছেন।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুমের অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও প্রতি বারের মতোই ফোন রিসিভ করেননি তিনি।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুদ্দোহা বলেন, কে সহিনুর? বাড়ি কেথায়? আমি তাকে চিনি না। তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই কর্মকর্তা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App