×

জাতীয়

ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারামেডিকেল টিম নেই, প্রয়োজন উন্নত প্রশিক্ষণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৬ এএম

ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারামেডিকেল টিম নেই, প্রয়োজন উন্নত প্রশিক্ষণ

ছবি: সংগৃহীত

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে যে কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে সবার আগে সাড়া দানকারী সংস্থা ফায়ার সার্ভিসের। প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। ফায়ার ফাইটাররাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিচ্ছেন উদ্ধার অভিযানে। কিন্তু বড় দুর্যোগে পর্যাপ্ত আধুনিক সরঞ্জামের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতার ছাপ ফুটে ওঠে সংস্থাটিতে। ছোট আগুন দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আনলেও বড় অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে দীর্ঘ সময়। বড় বিস্ফোরণেও দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট। এতে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রাণহানিও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আধুনিক সরঞ্জাম থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলো অপ্রতুল। নেই ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারা মেডিকেল টিম। ফলে বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হয় সংস্থাটিকে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রশিক্ষণে জোর দিয়ে উন্নত বিশ্বের ফায়ার সার্ভিসের আদলে আধুনিক সরঞ্জাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় বাড়াতে হবে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ। তা না হলে, উদ্ধার অভিযানে সময় লাগবে অনেক। বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও।

এদিকে সীমাবদ্ধতার কারণে রাজধানীর সিদ্দিকবাজার এলাকায় বিস্ফোরিত কুইন সেনিটারি মার্কেট ভবনে উদ্ধার অভিযানও বন্ধ রাখতে হয়েছে। বিশেষ করে ভবনটির বেজমেন্টে উদ্ধার অভিযান চালাতে শোরিং (ঠেক দেয়ার) নামের বিশেষ যন্ত্রের অভাবে বন্ধ রাখা হয় উদ্ধার অভিযান। যা ফায়ার সার্ভিসের কাছে নেই। ঘটনার দুদিন পর রাজউক সেখানে বিম বসানোর কাজ শুরু করে। এরই মধ্যে বেজমেন্টে আর মরদেহ নেই নিশ্চিত হয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যায় ফায়ার সার্ভিস।

বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট কাজ করলেও বেজমেন্টের সর্বশেষ মরদেহ উদ্ধার করা হয় দুদিন পর। তাও ফায়ার সার্ভিস থেকে বলা হয়, ‘মাছি ওড়া’ দেখে লাশের অবস্থান নিশ্চিত হয় তারা। বিস্ফোরণের পরের দিন ফায়ার সার্ভিসের কাজে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা যায় অনেক স্বজনকেও।

শুধু এই ঘটনাই নয়, ২০২১ সালে রুপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজ কারখানার নিচতলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৭ ইউনিট কাজ করলেও আগুন ঠিকই ছড়িয়ে পড়ে কারখানার সবগুলো ফ্লোরে। আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগে প্রায় দুদিন। ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থতার কারণেই হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলেও তখন অভিযোগ করে এলাকাবাসী। ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর বিকালে রাজধানীর ডেমরায় কোনাপাড়া মাদ্রাসা রোডে পাশা টাওয়ারের ১০তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতেও হিমশিম খেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। ১৬ ইউনিটের ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ততক্ষণে পুড়ে যায় ভবনটির ৬টি তলা।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাতেও হিমশিম খেতে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিসকে। এফ আর টাওয়ারে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের আগুন নেভাতেই সময় লেগে যায় সাত ঘণ্টারও বেশি। ২০১৬ সালে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের একটি ফ্লোরের একাংশের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিটের সময় লাগে ১০ ঘণ্টারও বেশি। আর ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি গুলশানের ডিসিসি মার্কেটে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট, নৌবাহিনী, রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্টের কর্মীদের লাগে প্রায় ১৬ ঘণ্টা।

সংশ্লিষ্ট কর্মীদের আন্তরিকতা, সাহস এবং মানবিক তৎপরতা সমালোচনার ঊর্ধ্বে হলেও জনবল এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সংস্থাটির দুর্বলতা তাদের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে এ সংস্থার প্রাধিকারপ্রাপ্ত মোট জনবল ১৩ হাজার ১১০ জন। কর্মরত আছেন ১০ হাজার ৮৯৩ জন। যার মধ্যে ফায়ারম্যানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফায়ার সার্ভিসে অন্তত ৩০ হাজার জনবল প্রয়োজন বলে মনে করেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংকট নিরসনে সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের ল্যাডার (মই), জাম্বু কুশন, লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট, ডাইভিং অ্যাপারেটাস, এয়ার কমপ্রেসর মেশিন, রিমোট কনট্রোল ফায়ার ফাইটিং ইউনিট, হেভি ডিউটি লাইট ইউনিট, টোয়িং ভিহিক্যাল, পোর্টেবল পাম্প, বিদ্রিং অ্যাপারেটাস ও স্মোক ইজেক্টরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যুক্ত করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

সূত্র জানায়, সারাদেশে ল্যাডার (মই) রয়েছে ২০টি। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৯টি। এর মধ্যে সম্প্রতি সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের দুটি ল্যাডার কেনা হয়েছে। ৫৪ মিটার ও ২৭ মিটারের ল্যাডার রয়েছে। বিশেষায়িত গাড়িও বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. মেহেদী হাসান আনসারী বলেন, দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য দেশে ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার নেই। উদ্ধার কার্যক্রম দ্রুত পরিচালনার জন্য যে ধরনের প্রযুক্তি থাকা দরকার, তা আমাদের সংস্থাগুলোর নেই। আবার যেসব আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে, তা ব্যবহার করতে জানা কর্মীর অভাব রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিসের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। যেমন কোনো ভবন ধস হলে সেখানে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে শোরিং সাপোর্ট দরকার। যা ফায়ার সার্ভিসের নেই। ফলে গুলিস্তান ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃতদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। শুধু শোরিং সিস্টেম নয়, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো আধুনিক সরঞ্জাম যুক্ত করতে হবে ফায়ার সার্ভিসের।

তিনি বলেন, টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ আরো বাড়াতে হবে। কারণ বড় অগ্নিকাণ্ড হোক কিংবা বিস্ফোরণ বা ভবন ধসের ক্ষেত্রে সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দ্রুত সময়ের মধ্যে হতাহতের শিকার ব্যক্তিকে উদ্ধার করা না গেলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। আর এই কাজগুলো টেকনিকক্যাল প্রশিক্ষণ নেয়া ফায়ার ফাইটার ছাড়া সম্ভব নয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক ভলেন্টিয়ার ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে বিল্ডিং কোড ব্যতিত যাতে কোনো ভবন গড়ে না ওঠে সেদিকে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। ধাপে ধাপে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর আদলে ফায়ার সার্ভিস আধুনিক সরঞ্জামে সমৃদ্ধ হচ্ছে। তবে কোনো বড় দুর্যোগ ফায়ার সার্ভিস মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে। এই সক্ষমতা হয়তো বিশ্বের কোনো দেশের ফায়ার সার্ভিসের নেই। তবে, দুর্যোগ মোকাবিলা একটি সমন্বিত কাজ। বড় ঘটনা ঘটলে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করে থাকে। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে বাংলাদেশ খুব বেশি পিছিয়ে নেই।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনবল স্বল্পতা ফায়ার সার্ভিসের একটি বড় সংকট। সরকার জনবল বাড়ানোর কাজ করছে। এর পাশাপাশি প্যারা মেডিকেল টিম যুক্ত হলে উদ্ধারকাজে আরো ভালো হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App