×

সারাদেশ

সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদী এখন ফসলের মাঠ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৩, ০৫:৫০ পিএম

সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদী এখন ফসলের মাঠ

ছবি: ভোরের কাগজ

সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদী এখন ফসলের মাঠ

ছবি: ভোরের কাগজ

সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদী এখন ফসলের মাঠ

ছবি: ভোরের কাগজ

মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার উত্তর পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া এক সময়ে প্রমত্তা ধলেশ্বরী নদীটি দিয়ে একসময় দুই-তিন তালা লঞ্চ ও স্টিমার চলত। প্রবল স্রোতে উত্তাল নদী শোঁ শোঁ শব্দে গর্জন করত। এ নদী থেকেই ধরা হত ইলিশ মাছ। দেখা যেত কুমির ও শুশুক। সেই খরস্রোতা নদীতে চর জাগায় লোকজন এখন বসতবাড়ি নির্মাণ করেছে। যতটুকু অবশিষ্ট আছে তাও আবার ফসলি জমি, বালুচর, আবার কোথাও মরা খাল ও নালায় পরিণত হয়েছে।

তথ্যসূত্রে জানা যায়, ধলেশ্বরী নদীটি টাঙ্গাইল জেলার পোড়াবাড়ীর ভাটিতে যমুনা থেকে সৃষ্টি হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে মানিকগঞ্জে প্রবেশ করে। জেলার ঘিওর ও সাটুরিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই নদীর দৈর্ঘ্য ১৬৮ কিলোমিটার। সিংগাইর উপজেলার পশ্চিম প্রান্তে বায়রা-নয়াবাড়ী থেকে শুরু করে সাভারের বংশাই নদী পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার প্রবাহিত এই ধলেশ্বরী।

বতর্মানে দূষণ ও দখলে মানচিত্র থেকেই মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এ নদীর অস্তিত্ব। কোথাও ধূ ধূ বালুচর, আবার কোথাও একেবারে নিশ্চিহ্ন। ফলে হুমকিতে পড়েছে এলাকার কৃষি সেচ ও জীববৈচিত্র্য। তাই এখনই নদীটি খননের মাধ্যমে বাঁচানো না গেলে ভবিষ্যতে পরিবেশের ওপর এর মারাত্মক নেচিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

উপজেলা বিএডিসি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সেচ প্রকল্পের আওতায় নদীটির কাংশা থেকে ফোর্ডনগর মৌজা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার খনন করা হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। এতেও নদীটির প্রবাহ ফিরে আসেনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১৮ সালে নদীভাঙন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ‍্য ব্যবস্থাপনার বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ একনেকে পাশ হয়। ওই পরিকল্পনার আওতায় মানিকগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী পুনঃখননের উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড।

[caption id="attachment_412555" align="alignnone" width="1416"] ছবি: ভোরের কাগজ[/caption]

পাউবো সূত্র আরো জানায়, ধলেশ্বরীর উৎসমুখে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে সাটুরিয়ার তিল্লী থেকে সিংগাইরের ইসলামনগর পর্যন্ত ৪৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নদী খননের কাজ শুরু হয়। এ খনন কাজ শেষ হয় ২০২১ সালের শেষ দিকে। পাঁচটি গুচ্ছে (প্যাকেজ) এই খনন কার্যক্রমে চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয় ৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

মহাপরিকল্পনার আওতায় ধলেশ্বরী নদী খনন হয়েছে মাত্র দুই বছর আগে। এরই মধ্যে নদী পথের বিস্তির্ণ এলাকা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। নদীটির সিংগাইর উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের ইসলাপুর অংশে খনন করায় কিছুটা নদীর মতো মনে হলেও জয়মন্টপ ইউনিয়নের চর দূর্গাপুর, পূর্ব ভাকুম ও ধল্লা ইউনিয়নের নয়াপাড়া এবং খাসেরচর অংশে এখন আর নদীর কোন অস্তিত্বই চোখে পড়েনা। দীর্ঘ দিনেও খনন না করায় এ নদীর তলদেশে পলি জমে নাব্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই। নদীটির বেশির ভাগ অংশেই পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। সেসব অংশ পরিনত হয়েছে ফসলের মাঠ। কোথাও নালা আবার কোথাও বা হাঁটুপানিতে পা ভিজিয়ে পার হচ্ছেন অনেকে। বিলুপ্ত হচ্ছে নদী তীরবর্তী অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদ। এ অঞ্চলের শত শত জেলে পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে বেকারত্ব ঘোচাতে বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন পেশা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ধলেশ্বরী ও তার শাখা নদী এবং খালগুলোর প্রায় বেশির ভাগ অংশই চলে যাচ্ছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের দখলে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে দখলদার তালিকা করা হলেও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একটি প্রভাবশালী মহল সিন্ডিকেট তৈরি করে লাখ লাখ টাকার বালু ও মাটি বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে। এ নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে পৌর এলাকার কাশিমনগর খেয়াঘাটে মাটি ব্যবসায়ীদের সাথে স্থানীয় বাসিন্দাদের চলছে চরম উত্তেজনা। অপরিকল্পিতভাবে নদী খননের নামে অনেক কৃষকের জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পাশাপশি হুমকিতে পড়েছে পার্শ্ববর্তী এলাকার বাড়িঘর কাংশা ব্রিজ।

এদিকে, ধলেশ্বরী নদী দখল করে ধল্লা-ফোর্ডনগর এলাকায় গড়ে উঠেছে শিল্প কারখানা, ইটভাটা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ট্যানারি শিল্পের বিষাক্ত তরল বর্জ্য পাইপ দিয়ে ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন কলকারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত পানিও পরিশোধন না করেই ছেড়ে দেয়া হচ্ছে ধলেশ্বরীতে। এতে বুড়িগঙ্গার মতো ধলেশ্বরীও দূষণের কবলে পড়েছে। ফলে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জাতের দেশীয় মাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। দখল আর দূষণে নদীমাতৃক দেশের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। পরিবেশের ভারসাম্য ও নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।

নদীর তীরোবর্তী চর দূর্গাপুর গ্রামের সুরোজ মিয়া (৫৫), জামান মিয় (৭২) পূর্ব ভাকুমের ফজর আলী (৬০), নয়াপাড়ার আয়নাল বেপারী (৭৫) ও ফোর্ডনগরের আব্দুল লতিফের (৭২) সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, আমরা ছোটবেলায় দেখেছি এ নদীতে দু’তলা তিন তলা লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। প্রবল স্রোতে উত্তাল নদী শোঁ শোঁ শব্দে গর্জন করত। আমরা এ নদীতে ইলিশ মাছ ধরছি। কুমির ও শুশুক দেখছি। সেই খরস্রোতা নদীতে চর জাগায় লোকজন বসতবাড়ি নির্মাণ করেছে। দিন দিন ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীটি এখন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের দু’পারের মানুষের প্রাণের দাবি- অতি দ্রুত নদীটি খনন করে পানির প্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হোক।

[caption id="attachment_412556" align="alignnone" width="1439"] ছবি: ভোরের কাগজ[/caption]

বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারসিক) ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে ধলেশ্বরী নদীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দাবিতে বিভিন্ন সময়ে তারা কর্মসূচি পালন করছে। তাদের দাবি, মানব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নদীগুলোর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। নদী বাঁচলে কৃষি বাঁচবে, আর কৃষি বাঁচলে দেশের মানুষ বাঁচবে।

ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলনের নেতা অ‍্যাড. দীপক কুমার ঘোষ বলেন, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। নদী, পানি ও প্রকৃতির জন্য আগে যে নদীগুলো ছিল সেগুলো খনন করা কৃষি ফসল, পরিবেশ ও মানুষের জীবনের জন‍্য অতীব জরুরি। তাই ধলেশ্বরী নদীর অবশিষ্ট অংশ দ্রুত খনন করার জোর দাবি জানাই।

সিংগাইর উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও নির্বাহী কর্মকর্তা দিপন দেবনাথ বলেন, জেলা সমন্বয় সভায় আমার এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে এ নদীর ইসলাম নগর থেকে ধল্লা ইউনিয়নের ফোর্ডনগর পর্যন্ত খনন কাজের একটি প্রস্তাব পানি উন্নয়ন বোর্ডে পাঠানো হয়েছে। এটি পাশ হয়ে আসলেই নদীর এ অংশ খনন করা হবে। সাভার ট্যানারীর বর্জ্য ধলেশ্বরী নদী দূষণ করছেন বলে তিনি স্বীকার করেন।

মানিকগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, নদীদুষণ ও মরে গিয়ে নদীর পানির ফ্লো যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়বে। যা আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি। তিনি আরো বলেন- এ বিষয়ে প্রয়োজনী ব‍্যবস্থা নিতে জাতীয় নদীর রক্ষা কমিশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনুরোধ করছি।

  মানিকগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাঈন উদ্দীন বলেন, ধলেশ্বরী নদীর অবশিষ্ট অংশের খনন কাজের জ‍ন‍্য এবং ইতিপূর্বে খননকৃত অংশে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে মেন্টেনেন্স ড্রেজিংয়র জ‍ন‍্য অর্থ বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ের আবেদন পাঠানো হয়েছে। এখনো আমরা বরাদ্ধ পাইনি। পেলেই আমরা প্রয়োজনীয় অংশে খনন কাজ শুরু করবো।

এ ব্যাপারে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী মোবাইল ফোনে বলেন, নদী খনন ও দখল মুক্ত করতে আমি প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত দেখে ডিসি মহোদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব‍্যবস্থা গ্রহণ করবো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App