×

মুক্তচিন্তা

চোর-চোর খেলা দেখতে দেখতে একসময় সবই চুরি হয়ে যাচ্ছে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৩, ০১:৪৫ এএম

চোর-চোর খেলা দেখতে দেখতে একসময় সবই চুরি হয়ে যাচ্ছে
এক এক করে কয়েকটি গল্প দিয়েই না হয় আজকের বক্তব্য পেশ করি। যে বোঝার, সে ঠিক বুঝে নেবে- যে নয়, তার জন্য না হয় এ লেখাটা আজ লিখলাম না। বিড়ালের রাগ বেড়ার ওপরও নয়, বউকে বোঝাতে ঝিকেও নয়- সরাসরিই বলছি। তবে একটু ঘুরিয়ে বলছি। বুঝতে হলে সামান্য একটুখানি ভেতরে ঢুকতে হবে লেখার। অনেকদিন ধরেই আমরা সবাই চোর-চোর খেলা দেখছিলাম। কিন্তু তেমন খেলা দেখতে দেখতেই একদিন যে চোররা আমাদের সবকিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, তা যেন খেয়াল করে দেখতেই পারিনি। প্রথমেই এক বুদ্ধিমান চোরের গল্প। বরিশাল সদর উপজেলার চর কাউয়ায় ইয়াসিন খাঁ নামের এক পেশাদার চোর তালা ভেঙে গভীর রাতে এক মুদি দোকানের ভেতর ঢুকে পড়ে। দোকানের মূল্যবান জিনিসপত্র ব্যাগে গোছাতে থাকে একের পর এক। কিন্তু চুরি করতে গিয়ে কখন যে রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে গিয়েছে, তা বুঝতে পারেনি পেশাদার চোরটি। মালপত্র নিয়ে বের হতে গিয়ে দেখে, ভোরের আলো হয়ে গিয়েছে; চারপাশে অনেকের আনাগোনা। এ সময় বের হতে গেলে গণপিটুনিতে পড়ার আশঙ্কা আছে- এমনটা ভেবে সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন থেকে ৯৯৯-এ কল করে পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করে। পরে পুলিশ এসে চোর ইয়াসিনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। বুদ্ধিমান চোর ইয়াসিন গণপিটুনি থেকে পুলিশের কাছে ধরা পড়াটাই অধিক শ্রেয় বলে মনে করেছে। কেননা তার অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে, গণপিটুনিতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। মৃত্যু না হলেও গণপিটুনির পর অনেক সময় মাথা ন্যাড়া করে আলকাতরা মাখিয়ে দেয় পাবলিক; তারপর জুতার মালা গলায় পরিয়ে চারদিকে ঘোরায়। সবশেষে হয় পুলিশে দিয়ে দেয় অথবা মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। পুলিশ অনেক সময়ই মামলা দিতে পারে না। কেননা মামলার বাদী হতে কেউ ইচ্ছা পোষণ করে না। সাধারণ মানুষ হয়রানি এড়াতে থানা, পুলিশ, আদালতকে এড়িয়ে চলতে চায়। তাই ইয়াসিন গণপিটুনি থেকে পুলিশের কাছে যাওয়াটাই নিরাপদ মনে করে। ইয়াসিন পেশাদার চোর। তাই তার জন্য নিরাপদ জায়গাটা সে ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছে। পুলিশ, আইন, আদালত থেকেও তার কাছে ভয়ের জায়গা গণপিটুনি। দ্বিতীয় চুরির ঘটনা ঘটেছে বগুড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। বগুড়া জেলার বহু মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায়, বাড়ি বা কারখানার মিটার চুরি হয়ে গিয়েছে। চুরি যাওয়া মিটার নিয়ে গেলেও একটি চিরকুট চোর রেখে যায়। চিরকুটে লেখা থাকে- ‘মিটার পাওয়া যাবে’। তারপর একটি মোবাইল নম্বর দেয়া থাকে। ওই নম্বরে ফোন করলে দাবি করা হয় টাকা। মোবাইলে সেই টাকা মেটালে ফেরত আসছে মিটার। বাড়ি কিংবা কারখানার মালিক বাধ্য হয়ে এমন পন্থাই গ্রহণ করছে। কারণ বিদ্যুতের অফিস থেকে নতুন মিটার পেতে অধিক অর্থের প্রয়োজন। তার থেকে অনেক কম অর্থের বিনিময়ে চোর থেকে মিটার ফেরত পাচ্ছে তারা। তাই তারা পুলিশে খবর না দিয়ে কিংবা লোক জানাজানি না করে মিটার ফেরত নিতে ফোন করছে চোরকে। চোরের কাজ প্রত্যক্ষ করেন এমন একজন ভুক্তভোগী গোলাম মোস্তফা। একটি চালকলের মালিক তিনি। কয়েকদিন আগে তার চালকলের শিল্পমিটার চুরি যায়। গোলাম মোস্তফা খোঁজ নিয়ে জানেন, তার থ্রি-ফেজের শিল্পমিটার বিদ্যুৎ অফিস থেকে পেতে খরচ হবে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু তিনি তা না করে চিরকুটে থাকা নম্বরে ফোন করলে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে তার নিজের মিটারটিই চোরের কাছ থেকে ফেরত পান। এবার আরো একটি অতি চালাক চোর চক্রের গল্প। বাংলাদেশের সুন্দরবনকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অভয়ারণ্য ঘোষণা করা আছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় কোথায় কোথায় বাঘের বিচরণ, সে খবর একদল চোরাশিকারির কাছে থাকে। তারা বাঘ শিকারের উদ্দেশ্যে ওইসব জায়গায় বিষ মেশানো ছাগলের মাংস রেখে আসে। বিষাক্ত মাংস খেয়ে মৃত্যু হয় বাঘের। তারপরই সংঘবদ্ধ চোর দল বাঘের চামড়া ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে যায়। পরে তা পাচার করা হয়। সম্প্রতি এই চোর দলের দুজন সদস্যকে আটক করে বিষয়টি জানতে পারে র‌্যাব। বাঘের চামড়া ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্রেতা সেজে র‌্যাব এই চোর চক্রের দুই সদস্যকে ধরতে সক্ষম হয়। ধৃত সদস্যরা শিকার করেছে, তারা মাছ ও গোলপাতা সংগ্রহের নাম নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। এরও আগে হাবিব তালুকদার তথা ‘বাঘ হাবিব’ নামের আরো একজন চোরকে আটক করা হয়েছিল। গত ২০ বছর ‘বাঘ হাবিব’ নাকি একাই ৭০টি বাঘ মেরেছে এসব অভিনব কায়দায়। এবার আর একটু অন্য ধরনের চোরদের গল্পে যাওয়া যাক। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিরা মনিরকে চিনেন না- এ যেন কল্পনাই করা যায় না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের (মাউশি) খুলনা অঞ্চলের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে মনিরের পদ উচ্চমান সহকারী। মনির রীতিমতো সেই অফিসে ‘ঘুষযন্ত্র’। নিজস্ব গাড়িতে ঘুরে ঘুরেও তিনি ঘুষের টাকা সংগ্রহ করেন। রাজধানী ঢাকায় মনিরের কেনা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন মনিরের স্ত্রী। রাজধানীর বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে তার স্ত্রীর নামে কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর। নিজ জেলা চুয়াডাঙ্গার মুসলিম পাড়ায় ১৪ কাঠা জমির ওপর মনিরের রয়েছে নিজস্ব একটি বাগান বাড়ি। মনিরের রয়েছে দ্বিতীয় স্ত্রী, যার নামেও আছে বাড়ি এবং ব্যাংকে মোটা অঙ্কের অর্থ। মনিরের মতো আরো এক ঘুষযন্ত্রের নাম শ্যামল। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের (মাউশি) ময়মনসিংহ আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে কর্মরত কম্পিউটার অপারেটর রইসউদ্দিন শ্যামল। তিনি প্রিমিও মডেলের গাড়িতে চলাফেরা করেন। শ্যামল ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় জায়গা-জমিসহ কয়েকটি ভবনের মালিক। এমপিওভুক্ত হতে হলে নিজ নিজ এলাকায় এই দুজন ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতেই হবে। তারাই চুক্তি নিয়ে কাজটি করে দিচ্ছে। দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির যে তালিকা সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে উপস্থাপন করেছেন, তাদের অর্ধেকই বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহক। ব্যাংকের লেনদেনের সময়সূচি সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা হলেও ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখা রাত ৮টার পর ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড নামে এক গ্রাহককে তাদের ঋণের টাকা থেকে নগদ ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা তোলার সুযোগ দিয়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংক পর্ষদের ৪৭৫তম সভায় ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ঋণ নবায়নের প্রস্তাব ওঠে। প্রস্তাব ওঠার আগেই পর্ষদের আলোচ্যসূচি দেখে ২৭ ডিসেম্বর ব্যাংকটিতে নিযুক্ত সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি আপত্তি জানিয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে জানিয়ে দেন। এরপরও ঋণ আনুমোদন হয়। সভায় ব্যাংকটির কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমন্বয়কের আপত্তির কথা জানালেও ঋণ নবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন হয়ে যায়। সেদিনই গ্রাহক গুলশান করপোরেট শাখা থেকে ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা তুলে নেয়। এমন ধরনের গল্প আরো অনেকই বলা যায়। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সমাজের সর্বত্র। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রায় একই রকমের চুরি করার প্রবণতা। ছোট চুরি, মাঝারি চুরি কিংবা বড় চুরি- সবই চুরি। কেউ করছে ব্যক্তির জিনিসপত্র চুরি, কেউ করছে প্রাকৃতিক সম্পদের চুরি, কেউ-বা করছে রাষ্ট্রের তথা জনগণের অর্থ চুরি, কেউ-বা করছে ব্যাংকের টাকা চুরি। সবই শেষ অর্থে চুরি হিসেবেই গণ্য হবে। তবে চুরির গুরুত্ব এখানে ভিন্ন। দোকানের জিনিসপত্র চুরি করা ইয়াসিন খাঁর চুরি, ব্যাংকের ঋণখেলাপি এবং সরকারি অর্থ আত্মসাতের চুরি একপাল্লায় মাপার কোনো উপায় নেই। ইয়াসিন একজন দোকানিকে পথে বসাচ্ছে, বিদ্যুতের মিটার চুরি করে চোর চক্র গুটিকয়েক ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীর ক্ষতি করছে, ঋণখেলাপি করে ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা ফেরত না দিয়ে একদল রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভাগ্যবান ব্যক্তি হাজার হাজার লগ্নিকারীর টাকা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে এবং আর একদল সরকারি সুযোগে ভাগ্য গড়ে ওঠা ভাগ্যবান লোক সরকারের অর্থ লুটপাট করে লাখ লাখ জনগণের উন্নয়ন ব্যাহত করছে। শেষের দলটি আরো একটা কাজ করে। তার ক্ষমতাশীল পজিশনের সুযোগ নিয়ে, তার সার্ভিসের নামে অবৈধ অর্থ নিচ্ছে ভুক্তভোগী নাগরিকদের কাছ থেকে। এরা তো অনেক টাকার মালিক বনে যাচ্ছেই- এমনকি এদের দালালি করেও অনেকেই বনে যাচ্ছে প্রচুর অর্থের অধিকারী। তাদের হাতিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দালালি করা। এক অংশ আমার, অন্য অংশ তোমার। এই ভাগাভাগির খেলায় বেশিরভাগ সময় দালালরাই অধিক অর্থ পাওয়ার পথ পেয়ে যায়। এসব চোর চক্রের হয়তো প্রত্যেকেরই নিজস্ব বক্তব্য আছে, বিশ্লেষণ আছে। কিন্তু ধোপে টিকে না তাদের কোনো যুক্তিই। কেননা তারা বলির পাঁঠা হলেও তাদের হাত ধরেই সমাজে-রাষ্ট্রে অবৈধ অর্থের স্রোতের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। পেছনে হয়তো আরো অনেক লোক, অনেক হাত। এই পেছনে থাকা আসল অথরিটি সম্পন্ন লোকগুলো ভাগাভাগি করে একে অপরের স্বার্থ দেখাশোনা করছে। তাই ঋণখেলাপি সেখানে শুধু অ্যাকাউন্ট হোল্ডাররাই নয়, সে ঋণ পাওয়ার আগে এবং পরে যাদের মাঝে অর্থ বিলিয়েছে, তারাও সমানভাবে ভাগীদার এ অবৈধ লেনদেনে। সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App