×

অর্থনীতি

গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রত্যাহারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৩, ০৯:১০ এএম

গ্যাস-বিদ্যুতে ভর্তুকি প্রত্যাহারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে

ছবি: সংগৃহীত

ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। এ কিস্তির পরিমাণ ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। আইএমএফের অনুমোদন করা ঋণ পেতে বাংলাদেশকে মোটা দাগে পাঁচ ধরনের সংস্কারকাজ করতে হবে। যেসব সংস্কারের ব্যাপারে আইএমএফ ও বাংলাদেশ একমত হয়েছে সেগুলো হলো, রাজস্ব সংস্কার, মুদ্রা ও বিনিময় হারের সংস্কার, আর্থিক খাতের সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত সংস্কার এবং সামষ্টিক কাঠামো সংস্কার।

আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত এসব সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকলেও কিছু কাজ করতে হবে অনেকটা জরুরি ভিত্তিতে, আগামী এক বছরের মধ্যে। সরকার ইতোমধ্যে সংস্কারকাজে হাত দিয়েছে, যার প্রভাব জনজীবনে পড়তে শুরু করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূল জায়গাগুলোতে সরকার এখনো সংস্কার করছে না। তাদের মতে, ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব খাতে সংস্কার করা হলে ভর্তুকি কমানোর প্রয়োজন হতো না। ফলে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকত।

বিংশ শতাব্দির শুরু কোভিড-১৯ এর মাধ্যমে, এরপর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর ফলে বিশ্বের অনেক দেশই চরম অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে আছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। ফলে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে এবং প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। আর এ সময়ে আইএমএফের গুরুত্ব ও প্রভাব অনেক বেড়েছে। ফলে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ৪৪টি দেশ আইএমএফ থেকে ১৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ নিয়েছে। সাধারণত যেসব দেশ দেউলিয়া হয়ে বেল আউটের জন্য আবেদন করে, তাদের জন্য তুলনামূলক কঠিন শর্ত দেয়া হয়। আর অন্যদের জন্য সাধারণ কিছু শর্ত পালন করতে হয়। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে যে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে, তা বেল আউটের অংশ নয়। তাহলে শর্তের মধ্যে অবশ্যই দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেয়ার কথা থাকত।

বাংলাদেশ যে এবারই প্রথম আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে, তা নয়। ছোট-বড় মিলিয়ে সংস্থাটি থেকে মোট ১০ বার ঋণ নিয়েছে আগে। প্রতিবারই কিছু শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফ এ ঋণ দিয়ে থাকে। সবশেষ আইএমএফ ঋণের জন্য ৩০টি শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে। ৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যে ছাড় করা হয়েছে। এছাড়া আইএমএফের নবগঠিত রেজিলিয়েন্স এন্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় বাংলাদেশ পাবে ১৪০ কোটি ডলার। বাংলাদেশই প্রথম এশীয় দেশ, যারা এ তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে। ২ দশমিক ২ শতাংশ সুদে নেয়া এ ঋণ আসবে সাত কিস্তিতে। কিস্তি শেষ হবে ২০২৬ সালে।

আইএমএফের শর্তের পরিপালন করতে গিয়ে সরকার কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, আইএমএফের প্রধান প্রধান শর্তের মধ্যে ব্যয় সংকোচন, কিছু কিছু জায়গায় ভর্তুকি কমানোর জন্য বলেছে। ইতোমধ্যে সরকার এ জায়গাগুলোতে সংস্কার শুরু করেছে। কিন্তু ব্যাংকের সুদহার, এক্সচেঞ্জ রেট বাজারমুখী করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার, এনবিআরের সংস্কার করে সরাসরি ট্যাক্সেশন বাড়ানো- এসব জায়গাগুলোতে এখনো হাত দেয়নি। এগুলোতে সংস্কার করা হলে সরকারের ভর্তুকী দেয়ার সক্ষমতা বাড়বে, ব্যয় সক্ষমতাও বাড়বে। মূল জায়গাগুলোতে সংস্কার না করে সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি, ভর্তুকি কমানো- এগুলো সংস্কার করছে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফিতির চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

গুণগত মান উন্নয়ন : এরমধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সংশোধন করা। আরেকটি শর্ত হলো, বাজেট ঘাটতি যেন অসহনীয় পর্যায়ে না যায়, যার কারণে সরকারকে চাপে পড়তে হয়।

অবকাঠামোগত মান উন্নয়ন : এর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় বাড়ানো, নতুন আয়কর আইন সংসদে পাস করে কার্যকর করা, জ¦ালানির দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পদ্ধতি কার্যকরসহ আরো বেশ কিছু সংস্কার।

সাধারণ শর্ত : অন্যান্য শর্তের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো, ব্যাংকের আমানত এবং ঋণের সুদের হার বাজার দরের উপর ছেড়ে দেয়া, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো প্রভৃতি। আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত এসব সংস্কার কার্যক্রম চলমান থাকলেও কিছু কাজ করতে হবে আগামী এক বছরের মধ্যেই; যেমন- কর রাজস্বব্যবস্থা, যাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর আদায় হয়। আগামী জুনের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে আইএমএফ। আগামী বাজেটেই এ সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক এবং ভ্যাট বিভাগে কমপ্লায়েন্স ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। আর এটি করতে হবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে।

সরকার প্রতিবছর বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ বাবদ বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারকে সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে। পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সমন্বয়ের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া- ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজটি করতে হবে। ট্রেজারি সিঙ্গেল অ্যাকাউন্ট বা সরকারি কোষাগারের অর্থ জমার একক ব্যাংক চালুর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে একটি নীতি প্রণয়নের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে এই কাজটি করতে হবে। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংককে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে একটি সুদহার করিডোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সংজ্ঞা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের হিসাব করতে হবে। মূলত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব প্রদর্শনের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এ কাজটি করতে হবে জুনের মধ্যে। পাশাপাশি একই সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

আইএমএফের শর্ত মেনে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করতে হবে। এ ছাড়া ঝুঁকিভিত্তিক তদারকির কর্মপরিকল্পনা নিয়ে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প আগামী জুনে শেষ করতে বলা হয়েছে। আর সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২০ এবং আর্থিক কোম্পানি আইন ২০২০ জাতীয় সংসদে পেশ করতে হবে। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর খারাপ সম্পদের তথ্য প্রকাশের শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। এ কাজটি করতে হবে জুনের মধ্যে।

শর্ত পালনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব প্রভাব পড়ছে : এই ঋণের ফলে দেশে সাময়িকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কিছুটা কমবে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। যে কোনো সংকটে অন্য কোথাও থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে শর্ত কিছুটা নমনীয় থাকবে। তবে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কমানোর ফলে প্রতিটি উৎপাদন খাতে ব্যয় বেড়েছে। কৃষি খাতে উৎপাদন ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে করে প্রায় দুই কোটি পরিবারের খাদ্য সরবরাহ হুমকির মুখে পড়েছে। ২০২৬ সালের পর সুদসহ ঋণ পরিশোধের সময় একটা বড় চাপের মুখে পড়বে। সেখান থেকে আবার অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

নির্বাচনী বছরে শর্তগুলো বাস্তবায়ন করাও সরকারের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি সরকারই চায় তাদের ভাবমূর্তি জনগণের কাছে বজায় রাখতে। কিন্তু জ্বালানি দ্রব্যের ভর্তুকি কমানো, ব্যাংকের আমানত সংক্রান্ত বিষয়গুলোর পরিবর্তন জনগণের মনে সরকারের প্রতি বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এসব অবস্থার মধ্যেই সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শর্ত বাস্তবায়নের। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে জিনিসপত্রের দামের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। সরকার এসব বিষয়ে আর ভর্তুকি দিতে রাজি চাচ্ছে না। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে বর্তমানে যে জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক বাজারদরের কাছাকাছিই আছে। সারে অবশ্য ভর্তুকি বহাল আছে এবং থাকবেও। এ ব্যাপারে আইএমএফও কিছু বলেনি। অর্থনীতির বর্তমান সময়ে চরমভাবে চাপে পড়েছে নিন্ম আয়ের মানুষ। কারণ, মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করেছে। আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী যদি ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেয়া হয় তাহলে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ বাড়িয়ে দেবে। এতে পণ্য ও সেবা উৎপাদনের খরচ বাড়বে। তাতে পণ্যের দামও বেড়ে যেতে পারে, যার ভুক্তভোগী হবেন সাধারণ মানুষ। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে প্রতিবছর অভ্যন্তরীণ ঋণের যতটুকু সংগ্রহ করে সরকার, তা এক-চতুর্থাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছে আইএমএফ।

অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর এতে রাজি বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। মুনাফা থেকে কর কেটে রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ এখন এমনিতেই কম। আইএমএফের পরামর্শ মেনে সরকার এখন আরো কিছু বিধিবিধান তৈরি করবে, যাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি চূড়ান্ত বিচারেই তলানিতে নামবে। আইএমএফ বলেছে ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের মধ্যে ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে। ব্যাংকের পুনঃতফসিল করা ঋণকেও খেলাপি ঋণের হিসাবে আনা হচ্ছে, যা আগামী জুনের মধ্যে কার্যকর হবে বলে আইএমএফকে জানিয়েছে বাংলাদেশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App