×

জাতীয়

ভিন্ন ধর্মের তরুণদেরও ধর্মান্তর করেছে ‘শারক্বিয়া’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২৩, ০৭:০৮ পিএম

ভিন্ন ধর্মের তরুণদেরও ধর্মান্তর করেছে ‘শারক্বিয়া’

গ্রেপ্তার চার জঙ্গি

নতুন সৃষ্টি হওয়া ইসলামী জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’ শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদেরকে নয়, ভিন্ন ধর্মের তরুণদেরকেও নানাভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে তাদের দলে ভিড়িয়েছে তারা। গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া বাইপাস এলাকা থেকে এই জঙ্গি সংগঠনের চারজন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাব সদর দপ্তর ও চট্টগ্রাম জোনের যৌথ অভিযানে পটিয়া থেকে চারজন গ্রেপ্তার হলেও আরও প্রায় চার-পাঁচজন পলিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কথিত ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে (দাওয়াত) ঘর ছেড়ে (হিজরত করে) চারজন তরুণ পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন পাহাড়ে গিয়ে রণকৌশল ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেন। এই চার তরুণ ছয় মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন। র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযানের মুখে পাহাড় ছেড়ে সমতলে এসে ধরা পড়েছেন এসব তরুণ। গ্রেপ্তার হওয়া চারজন হল- হোসাইন আহমদ (২২), নিহাল আব্দুল্লাহ (১৯), মো. আল আমিন (২২) ও আল আমিন ওরফে পার্থ (২১)।

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব সদর দফতরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, হোসাইন রাজধানীর একটি মাদরাসায় অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০২১ সালের নভেম্বর নিখোঁজ হন। আল আমিন কুমিল্লার একটি মাদরাসায় পড়া অবস্থায় একই বছরের আগস্টে নিরুদ্দেশ হন। নিহাল আবদুল্লাহ ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। ওই বছরের আগস্টে ঘর ছেড়ে যান তিনিও। গ্রেপ্তার হওয়া ২১ বছর বয়সের আল আমিন তার বাড়ি খুলনায় একটি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে। তখনকার পার্থ কুমার দাশ ২০১৮ সালে স্থানীয় এক ইমামের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয়ে নাম পরিবর্তন করেন। এরপর ঘর ছেড়ে রাজধানীতে গিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীর চাকরি নেন। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের কমান্ডার আরো বলেন, হোসাইন ও আল আমিন ওরফে পার্থ জনৈক সিরাজের মাধ্যমে শারক্বিয়া সংগঠনে যোগ দেন। আল আমিনকে তার মাদরাসার সহপাঠী ফাহিম ও নিহালকে কুমিল্লার কুবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহ সংগঠনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। ‘সংগঠনে যোগ দেয়ার পর তাদের প্রত্যেককে প্রথমে তাত্ত্বিক ও শারীরিক কসরতের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে ও প্রতিবেশী দেশে কথিত মুসলিমদের নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয় তাদের। কুমিল্লা, পটুয়াখালী, ভোলা, সাভার, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে তুলে দেয়া হয় শারক্বিয়ার অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিবের কাছে। রাকিব তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও রণকৌশল শেখানোর জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের বাকলাই পাড়া হয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।’

সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার মঈন আরো জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ক্যাম্পে শারক্বিয়ার সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। শারক্বিয়ার আমির আনিসুর রহমান মাহমুদের ঘনিষ্ঠজন কেএনএফের প্রধান নাথাম বম। আমিরের অনুরোধে পাহাড়ে অর্থের বিনিময়ে আশ্রয়, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, বোমা তৈরি এবং অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের কাজ করছিল কেএনএফ।

গ্রেপ্তার হওয়া শারক্বিয়ার সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পেরেছে, বিভিন্ন সময় কেএনএফ প্রধান নাথান বম, বাংচুং, রামমোয়, ডিকলিয়ান, পাহল ও কাকুলীসহ অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেছেন। পরবর্তীতে র‌্যাবের অভিযানের মুখে আমিরের নির্দেশে শারক্বীয়ার সদস্যরা কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে পার্বত্য অঞ্চলের সাইজামপাড়া, মুন্নুয়াম পাড়া, রোয়াংছড়ি, পাইক্ষংপাড়া, তেলাং পাড়ায় আত্মগোপন করে থাকে। ‘গ্রেপ্তার চারজন আত্মগোপনের জন্য বান্দরবান থেকে সমতলের দিকে এসেছিল। চারদিন হেঁটে তারা দুর্গম থেকে হেঁটে বান্দরবানের টঙ্কাবতী এলাকায় আসে। এরপর সিএনজি অটোরিকশায় করে পটিয়া বাইপাস এলাকায় এসে ধরা পড়ে তারা।’ এসময় আরো চার-পাঁচজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন।

২০২২ সালের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট তরুণ নিখোঁজের একটি ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হলে অনুসন্ধানে নেমে র‌্যাব ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির সন্ধান পায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এমন তথ্য পায় র‌্যাব। মাসখানেক ধরে গোয়েন্দা নজরদারির পর অক্টোবর থেকে রাঙামাটির বিলাইছড়ি, বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, থানচি, কক্সবাজারের কুতপালংসহ বিভিন্ন এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে র‌্যাব।

খন্দকার আল মঈন জানান, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত র‌্যাবের অভিযানে শারক্বিয়ার মোট ৫৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যার মধ্যে সামরিক শাখার প্রধান রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ বাশারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন জঙ্গিনেতা আছেন। এছাড়া, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া কেএনএফ’র ১৭ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

এর আগে র‌্যাব কথিত হিজরতের উদ্দেশে বেরিয়ে যাওয়া ৫৫ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। মঈন জানান, এর মধ্যে সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়া চার তরুণসহ ২৭ জনের সন্ধান পেয়ে র‌্যাব তাদের উদ্ধার করেছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে তাদের অভিভাবকের জিম্মায় দেয়া হয়েছে।

এছাড়া, আরো দুজন নিহত হয়েছেন ও দুজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। আরো ২৪ জন এখনো নিখোঁজ আছেন। সর্বশেষ গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে নিহাল আবদুল্লাহ কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া আটজন তরুণের একজন। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শারক্বিয়া ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে দুটি হত্যাসহ মোট পাঁচটি মামলা আছে। বান্দরবানের থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়ি, রাঙামাটির বিলাইছড়ি, কুমিল্লার লাকসাম ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া চারজন তরুণকে বিলাইছড়ি থানার দায়ের করা মামলায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App