×

মুক্তচিন্তা

প্রকৃত সত্য আর প্রকৃত মিথ্যা পার্থক্য কোথায়?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৫:৪৫ এএম

আমরা এই দার্শনিকতা নিয়েই বাঁচি- সবই সত্য কিংবা সবই মিথ্যা। দুটিই চরম স্তরের। আবার আমরা যদি অর্ধেক অর্ধেক ভাগাভাগি করি সত্য-মিথ্যা, তাহলে বর্তমান জীবনটা হবে নকল আর নিকেলের গলাগলি। আমাদের সমাজ ও মানসিকতা এই রকম গলাগলিতে ভরপুর। সত্য এবং মিথ্যা কীভাবে বাস করে তার একটি নমুনা দেখা যাক। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ইউক্রেনের অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধারের যে প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), সেটা মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই না। শুক্রবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে যখন দুপক্ষের মধ্যে এ সংক্রান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন এমন মন্তব্য করেন তিনি। (যুগান্তর : ০২/০৪/২৩) এই সংবাদটুকুতে সত্য ও মিথ্যা দুটিই আছে। সত্য হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইউক্রেনের অর্থনীতির দ্রুত পুনরুদ্ধারের যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে, তা সত্য উচ্চারণের একটি প্রাথমিক অংশ। দ্বিতীয় অংশ অচিরেই বাস্তবায়নের স্তরে আসবে। প্রথমে প্রতিশ্রæতি আর সেই প্রতিশ্রæতি রক্ষার জন্য তারা পদক্ষেপ নেবে। এটাকেই মিথ্যা বলছেন রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ। মেদভেদেভ কেন ইইউর প্রতিশ্রæতিকে মিথ্যা বলছেন? এর কারণ দুটি হতে পারে। এক. তিনি যেহেতু ভøাদিমির পুতিনের সামরিক নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপপ্রধান, সে জন্য তিনি এমনটা বলেছেন, ধরে নিতে পারি আমরা। তিনি যে কর্তৃত্বপরায়ণ পুতিনের মন রক্ষার কথা বলবেন, তাতে রাজনৈতিক কর্মচারীদের মাথায় সব সময় পেরেক মারা থাকে। পুতিনের মনে হাওয়া দিতেই তিনি এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন, যা মূলত সত্যের মতো শোনায়। দেখতেও সত্যের মতো। মেদভেদেভ সত্যের মতো দেখাটা যাতে পোক্ত দেখায় ও শোনায়, তাই তিনি কিয়েভের ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করেছেন। টেলিগ্রামে দেয়া পোস্টে তিনি গোল্ডম্যান সার্চের এক গবেষণার বরাত দিয়ে বলেন, ইউক্রেন যে এলাকা হারিয়েছে, তা দেশটির শিল্প ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ অবদান রাখত, যা জিডিপির ১৫ শতাংশ। সাবেক রুশ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ইউক্রেনের যে পরিমাণ ন্যাচারাল রিসোর্স (প্রাকৃতিক সম্পদ) হাতছাড়া হয়েছে, তার মূল্য ১২ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ কয়লা এবং ৪২ শতাংশ ধাতব (মেটাল) ক্ষেত্র। (যুগান্তর : প্রাগুক্ত) আমরা দিমিত্রির দেয়া তথ্য সত্য বলে ধরে নিচ্ছি। কিন্তু তার ভেতরে মিথ্যাও মেশানো থাকতে পারে। এটা ঠিক রাশিয়া যে পরিমাণ ভূমি দখল করে নিয়েছে, তার বৈধতা নিয়ে তিনি কোনো কথা বলেননি। কেন ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ চালালেন, তার কোনো ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য নেই। কেবল এটাই জানাল, ওই পরিমাণ খনিজ সম্পদের মালিকানা হারানো পরিস্থিতির পর কীভাবে তা পুনরুদ্ধার করে দেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন? দিমিত্রি এই সত্য বলেননি যে, তার দেশ, তার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন গত এক বছরে ওই পরিমাণ, যদি অঙ্কটা সত্য হয় ক্ষতি করেছেন, যা বিধ্বংসী কাজ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কত লোক মারা গেছে, ইউক্রেনের ভূমি দখল করতে গিয়ে কত নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যা করেছেন পুতিন, নিজ দেশের কত সেনাকে হারাতে হয়েছে এবং ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ ও সামরিক বাহিনীর কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, সেই তথ্য জানিয়ে মানবিক একটি আবেদনমূলক কথা যদি তিনি বলতেন, তাহলে দিমিত্রিকে মানুষ হিসেবে চিত্রিত করা যেত। কিন্তু তিনি শত্রæজ্ঞানে বিবৃতি দিয়েছেন, প্রকাশ করেছেন সন্দেহ, ইইউ কি পারবে ওই বিশাল ক্ষতি অতিদ্রুত পুষিয়ে উঠতে? আর এখানেই লুকিয়ে আছে যুদ্ধের প্রকৃত সত্য ও মিথ্যার বিষয়টি। আর জানা ও বোঝা যেত সত্য-মিথ্যার মধ্যে ফারাক কতটা। তাই আমি বলতে চাই তিনি সত্যের সূত্র ধরে মিথ্যা ও মিথ্যার সূত্র ধরে অনেকটাই সত্য বলেছেন, তবে মানুষের মানবিক দিকটি এড়িয়ে গেছেন। দুই. ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে, তার পেছনে রয়েছে মানবিকতার প্রকাশ এবং সত্য রয়েছে সামরিক যান ও সামরিক অস্ত্রের বিজনেস। যুদ্ধটাকে দীর্ঘায়িত করার পেছনে রয়েছে যে নিষ্ঠুর ও নির্মম-সত্য, সেটা কি আমাদের বিশ্ব নেতারা জানেন না? নাকি অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও অস্ত্র ব্যবসার পেছনে রয়েছে যুদ্ধের মতো নৃশংস হত্যাযজ্ঞের যাত্রা। ওয়ার এন্ড পিস এই থিওরি তারা আবিষ্কার করে নিয়েছেন, যাতে আমরা বুঝতে পারি শান্তির জন্যই এই যুদ্ধ। কত বড় গলদকে একটি থিওরি দিয়ে জায়েজ করতে তারা তৎপর, আমাদের তা বুঝতে হবে আজ। পুতিন কেন ইউক্রেনে আক্রমণ চালালেন, তার পেছনে রয়েছে রাশিয়ান অস্ত্র ব্যবসায়ীদের উদগ্র ব্যবসার আগ্রহ। তাকে এড়িয়ে আসতে পারেননি পুতিন। তিনি সময় নিয়েছেন কিংবা উভয়পক্ষকে সুযোগ ও সময় দিয়েছেন অস্ত্র সমাবেশের। কারণ প্রচলিত অস্ত্রের মজুত শেষ করতে না পারলে ওয়ার ইন্ডাস্ট্রিজের ক্ষতি, যা অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারবে না কোনো পক্ষই। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের এক-দেড় মাস আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগেই বলেছিলেন, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে যাচ্ছে। তার পর থেকেই আমরা লক্ষ্য করে এসেছি প্রতিদিনই ইউক্রেন সীমান্তে সেনা সমাবেশ করছেন পুতিন। তখনো আমরা জানি না, সত্যই রাশিয়া আক্রমণ করতে যাচ্ছে কিনা। যাকে পুতিন বলেছিলেন অভিযান, কেননা আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীর তিনটি দেশ মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে যুদ্ধের মতো অমানবিক ও অনৈতিক অভিযান চালাবে না। আমরা ধারণা করেছিলাম, তাইওয়ান প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক বিরোধে জড়িয়ে পড়বে চীন। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন রণতরী ও চীনের ৯ ড্যাসের দ্বীপ সৃষ্টি করে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ ও অবস্থান উভয় পক্ষকে উত্তেজনার শীর্ষে নিয়ে যায়। সেই অবস্থাকে আরো তপ্ত করে দেয় মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির আকস্মিক তাইওয়ান সফর। ইন্দোচীন এলাকায় মার্কিন ও চীনের সামরিক টহল পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে ফেলে। শুভবুদ্ধির উদয় না হলে আমরা আরো একটি যুদ্ধের আঘাতে তছনছ হয়ে যেতাম। অর্থনৈতিক দুরবস্থার ঘানি গোটা বিশ্বকে এমন এক সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে আজ, তার খেসারত ইউক্রেন হারাচ্ছে তার খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। গোল্ডম্যান সার্চের তথ্য হয়তো সত্য, কিন্তু তার জন্য পুরোপুরিই দায়ী রাশিয়া ও তার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। রাষ্ট্র রাশিয়ার চেয়েও ব্যক্তি পুতিনের রাজনৈতিক গ্রাস করার যে সামরিক প্রজ্ঞা অনেকটাই আগ্রাসী। এই আগ্রাসী মনোভঙ্গির কারণেই তার প্রতিবেশী ইউক্রেন আক্রান্ত হয়েছে ২০১৪ সালে এবং হারিয়েছে ক্রিমিয়া দ্বীপটি। আমরা জানি, নেকড়ের স্বভাব সূত্রানুযায়ী পুতিন দাবি করেছে যে কৃষ্ণসাগরের ক্রিমিয়া দ্বীপটি রাশিয়ার। সেই লোভ থেকেই ইউক্রেনের জাতিগত রুশদের ষড়যন্ত্রে পুতিন আক্রমণ করে দখল করে নিয়েছে অনেক ভূমি, শহরাঞ্চল। দিমিত্রির হিসাব অনুযায়ী, ইউক্রেন হারিয়েছে ১২ ট্রিলিয়ন মূল্যের ন্যাচারাল রিসোর্স বা প্রাকৃতিক সম্পদ। এই হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধারের কথাই বলেছে ইইউর নেতারা। তার মানে তারা হারানো ভূমি রাশিয়ার হাত থেকে উদ্ধার করে ইউক্রেনের হাতে ফিরিয়ে দেবে। কীভাবে তা করবে ইইউ, তা নিয়েই সন্দেহ পোষণ করেছেন দিমিত্রি। অত সহজে ওই পরিমাণ সম্পদ পুনরুদ্ধার করতে পারবে না ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। কী করে পারবে? ইইউ যদি সামরিক কায়দায় নামে, তাহলে ওই পরিমাণ সম্পদ সেখানে পাবে না। তাহলে কি তারা রাশিয়ার ভেতরে ঢুকে পড়বে? এর মধ্যেই পুতিন বা তার সহচররা এ রকম কথা চাউর করেছেন যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে পুতিন পারমাণবিক যুদ্ধে নামতে পারেন। এদিকে পাকিস্তানের শাহবাজ সরকার অর্থনৈতিক ধস সামাল দিতে তার পারমাণবিক বোমা বিক্রির কথা ভেবেছে। কিন্তু কার কাছে এই বোমা সে বিক্রি করবে? আর কেই বা তা কিনবে? রাশিয়া পারমাণবিক শক্তির দেশ। ন্যাটোর অধিকাংশই পরমাণু শক্তির অধিকারী। কেনার একমাত্র দেশ ইউক্রেন। কিন্তু ইউক্রেনের হাতে টাকা নেই। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে পরমাণু বোমার ব্যবহার হলে আজকে যে নারকীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, এই পরিস্থিতি আরো একশ গুণ বাড়বে। আর সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হবে। মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না। থাকবে না সামরিক ক্ষমতার বাহুবলী। যাকে বলে কেয়ামত, সেই কেয়ামতই নেমে আসবে এবং পুতিনের মতো মারদাঙ্গা মানুষ এটাই চায়। মানুষ, মানবিকতা, মানবতা ওই শব্দগুলো তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় আছে বলে মনে হয় না।
তিন. আজ কেন উন্নয়ন উন্নয়ন বলে প্রাণপাত করছি আমরা? সত্য আর মিথ্যার এই গলাগলিতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App