×

মুক্তচিন্তা

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আজব খরা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৫:৪৫ এএম

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আজব খরা
সংবাদপত্রে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নেই আগের মতো। চাকরি খোঁজার অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোও নেতিয়ে পড়েছে। গত কয়েক মাসে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব প্ল্যাটফর্মে চাকরির বিজ্ঞাপন কমিয়ে দিয়েছে। কোম্পানিগুলো খরচ কমাচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ আসছে না। চাকরির বাজার কবে নাগাদ আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে, কবে থেকে আবার প্রচার হবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি? সেই টাইমফ্রেমও নেই তাদের কাছে। কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে বেকারত্বসহ চাকরির বাজার সংক্রান্ত তথ্যও নেই। সরকার মোট শ্রমবাজারের মাত্র সাড়ে তিন শতাংশের নিয়োগদাতা। সরকার ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারত্ব পরিস্থিতি নিয়ে অন্ধকারে। বেকারত্বের সরকারি সংখ্যা অযৌক্তিক, এ দিয়ে ফলপ্রসূ কৌশল তৈরিও অসম্ভব। বেকারত্বের সরকারি সংখ্যাও রেকর্ড করেছে। একটা সাধারণ পরীক্ষার ভিত্তিতে চাকরি নিয়োগের পদ্ধতি বিশ্বে অচল। এখানে ব্যক্তির অর্জিত অভিজ্ঞতা শিক্ষা ও দক্ষতার মান ও গুণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। সচরাচর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ দিয়ে কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান বের করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির কাছেও চাকরির বাজারবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য নেই। চার বছর পরপর তারা এ জরিপটি করে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে এ ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। বিবিএসের শিল্প ও শ্রম শাখা মাস কয়েক আগে শ্রমশক্তি জরিপের মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহে নেমেছিল। প্রকৃত তথ্য জানা না গেলেও তাদের জরিপের ফলটি পেলে গত বছর কয়েকে কী পরিমাণ কর্মসংস্থান কমেছে এর একটি ধারণা মিলবে। উঠে আসবে মানুষের আয়-ব্যয়, দারিদ্র্য, ক্রয়ক্ষমতার চিত্রও। সেই পর্যন্ত অপেক্ষার বিষয় থাকলেও বাস্তবতা বোঝা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার যার ঘরে-বাইরে, কর্মস্থলে, পরিবহনে সর্বত্র তা আঁচ করা যায়। পাঁচ বছর আগের হিসাবে, দেশের কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৯৫ লাখ। কাজের উপযুক্ত জনগোষ্ঠী ছিল ৬ কোটি ২১ লাখ। সেই হিসাবে বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬ লাখ। করোনা, বিশ্বমন্দাসহ নানা কারণে এই অঙ্ক কোন তলানিতে আসতে পারে অনুমান করা কঠিন। কারণ উল্লিখিত সময়ে হাজার হাজার মানুষের চাকরি বা কাজ খোয়ানো গেছে। কোথাও কোথাও তা এখনো চলছে। চাকরি রাখলেও বেতন কমানোর ঘটনা আছে অনেক। এ সময়ে চাকরিচ্যুত হওয়ার তুলনায় নতুন চাকরি পাওয়ার সংবাদ খুব কম। দেশের প্রায় ৮৫ থেকে ৮৯ শতাংশ শ্রমবাজার অপ্রাতিষ্ঠানিক। জরিপে তাদের হিসাব ঠিকভাবে আসে না। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক মিলিয়ে দেশে কর্মসংস্থানের অন্যতম খাত পরিবহন ও পোশাক শিল্প। সেখানে মুখে মুখেও চাকরি হয়। দুটি সেক্টরেই চরম খরার টান। সেখানে নতুন কর্মসংস্থান নেই। খরচ বেড়ে যাওয়ায় পোশাক খাতে কয়েক মাস ধরে নতুন নিয়োগ বন্ধ। সেখানকার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, প্রতি মাসেই কিছু কর্মী পূর্ব ঘোষণা না দিয়েই চাকরি ছেড়ে দেন। কেউ কাজ ছেড়ে গেলে শূন্য পদ পূরণের ঘটনাও কম। বিনিয়োগ না হলে নতুন কর্মসংস্থান হয় না, এটি সবারই বোধগম্য। পোশাক কারখানায় নতুন বিনিয়োগ নেই। সম্প্রসারণও স্থগিত। উপরন্তু প্রতি মাসেই সাত-আটটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের চলমান সংকট সমাধান না হলে এ পরিস্থিতি বদলানোর ন্যূনতম সম্ভাবনাও নেই পোশাক শিল্প খাতে। অনানুষ্ঠানিক চাকরি রাজ্যের অন্যতম পরিবহন খাতের অবস্থা আরো করুণ। পাঁচ বছর আগের হিসাবে, পরিবহন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬০ লাখ লোক কাজ করেন। এ খাতে কর্মসংস্থানের বড় অংশ রাজধানী ঢাকায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ সূত্রের তথ্য বলছে, গত তিন বছরে বাস, ট্রাক, সিএনজি, টেম্পো, ট্যাক্সিক্যাব নিবন্ধন ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন কর্মসংস্থানের বিষয় নেই সেখানে। চাকরির আরেকটি অনানুষ্ঠানিক জায়গা হোটেল-রেস্তোরাঁ। গত কয়েক বছরে খাবারের বহু দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। মানে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে সমানে। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাবে, কোভিডের আগে রাজধানীতে প্রায় ২০ হাজার রেস্তোরাঁ ছিল। এখন তা ১৬ হাজারের নিচে। সরকারি মহল কর্মসংস্থানের এমন হিসাব মানতে নারাজ। কোনো হিসাব বা সংখ্যাগত তথ্য দিতে না পারলেও বলছে, গ্রামও এখন শহর হয়ে গেছে। শহর থেকে গ্রামে অভিবাসন করা মানুষ গ্রামের শ্রমবাজারে কাজ করছে। কৃষি খাতে সারা বছর কর্মসংস্থানে অনেক টাকা আসছে। ৬০০ টাকা মজুরিতেও শ্রমিক পাওয়া যায় না। তার মানে কেউ বেকার থাকছে না। না খেয়েও মরছে না কেউ। সরকারি বাদে বেসরকারিতে আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিস্থল হচ্ছে- কোম্পানি, ফার্ম, অংশীদারি প্রতিষ্ঠান। এসবের নিবন্ধন আগের চেয়ে কমেছে। তিন বছর ধরেই এই প্রবণতা। যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৮২৬টি কোম্পানি, ফার্ম, অংশীদারি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়েছে। পরের বছর নিবন্ধন কমেছে আরো দেড় হাজার। এর অর্থও পরিষ্কার। বাংলাদেশের চাকরি বাজারে আগে থেকেই দক্ষ জনবল প্রাপ্তির সমস্যা রয়েছে। বাজার চাহিদার সঙ্গে শিক্ষার কোর্স-কারিকুলামের সংযোগ স্থাপিত হয়নি বলে এক পদের বিপরীতে শত শত আবেদনকারী থাকে, কিন্তু যোগ্য ও দক্ষ রিসোর্স পাওয়া যায় না। বরং আবেদনপত্র নিরীক্ষণে অপচয় হয় সময় ও অর্থ। করোনা মহামারি শুরুর পরের বছরই দেশের স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগের একটি গতি তৈরি হয়। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান তো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে যায়। তারা খাদ্য-ওষুধসহ নানা নিত্যপণ্যের সেবাভিত্তিক এবং সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে ব্যবসা করছে। নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে কয়েকটি। করোনার পর এ খাতও বসে পড়েছে। সামনে পরিস্থিতি কী হতে পারে, যে প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হবে তারা কতটা টেকসই হতে পারবে, কোন নীতিতে চলছে, মন্দা পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেয়ার মানসিকতা ও প্রস্তুতি আছে কিনা- এসব হিসাব মেলাতে পারছে না তারা। দেশীয় একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের স্টার্টআপে বিনিয়োগ নিয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত কিছু ধারণা মেলে। তাতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ পেয়েছিল, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা ধরে)। ২০২২ সালে এ খাতে বিনিয়োগ ৭৪ শতাংশ কমে ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলারে নেমে যায়। ২০২৩ সালে এসে নমুনা আরো খারাপ। বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৬০ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার, সঙ্গে শুরু হয়েছে স্বল্প দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমবাজারের বেকারত্ব। একদিকে কর্ম তৈরির সরকারি কৌশল নেই, অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও ডলার সংকট, বেসরকারি ঋণ-বিনিয়োগ খাতে পাচার ও কেলেঙ্কারিজনিত মন্দার থাবা। উৎপাদন ও কর্মসংস্থান নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে চলছে প্রযুক্তির শোরগোল। গত কয়েক বছর রোবট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন আলোচনা শুরু হয়েছে চ্যাটজিপিটি নিয়ে- এগুলো সবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত। ধারণা করা হচ্ছে, প্রযুক্তি মানুষের কাজ কেড়ে নেবে। এর সঙ্গে অনেকের ভিন্নমতও আছে। দ্য ইকোনমিস্টের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে- জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো রোবট ব্যবহারকারী দেশ যত বেশি রোবট, তত বেশি উৎপাদনের থিওরিতে এগোচ্ছে। পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যায় না, এমন কিছু দেশও রোবটে ঝুঁকছে। বিশ্বের বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় বিপুল বিনিয়োগ করলেও কাজ না থাকলে রোবট আর মানুষ বা ম্যানমেশিন বিতর্ক অবান্তর। এছাড়া বৃদ্ধিবৃত্তি ও মেধাঘন কাজ রোবটে হয় না। তার ওপর বিশ্বে মানবাধিকার নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে আরো মানবকেন্দ্রিক হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তাতে রোবট বড় সহায় হতে পারে না। মানুষের বিকল্প মানুষই। কাজের বিকল্প কাজই। সেই ক্ষেত্রে জনশক্তিকে দক্ষ করার বিকল্প নেই। একটা সাধারণ পরীক্ষার ভিত্তিতে চাকরি দেয়ার পদ্ধতি এখন বিশ্বে অচল। কারণ এতে ব্যক্তির অর্জিত অভিজ্ঞতা শিক্ষা ও দক্ষতার মান-গুণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। আধুনিক অটোমেশনকৃত উৎপাদন পরিবেশের সঙ্গে তাল মেলাতে শ্রমিকদের দক্ষতা অর্জনে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা, ট্রেনিং বাজেট ও ট্রেনিং জরুরি। দেশের বেকারত্বের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ ও চাকরি তৈরির মাসিক ড্যাশবোর্ডের কথাও ভাবা যায়। এসব না থাকায় সরকার ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারত্ব পরিস্থিতি নিয়ে মূলত অন্ধকারে। বেকারত্বের সরকারি সংখ্যা দিয়ে ফলপ্রসূ কৌশল তৈরি সম্ভব নয়। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App