×

মুক্তচিন্তা

অজয় বঙ্গা ও আমাদের আন্তর্জাতিক মেধার বিস্তার

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:১৬ এএম

ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার প্ল্যাটফর্ম মাস্টারকার্ডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অজয় বঙ্গা। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে মনোনয়ন দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বাইডেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইতিহাসের এই কঠিন মুহূর্তে বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অনন্যভাবে প্রস্তুত বঙ্গা। জলবায়ু পরিবর্তনসহ সময়ের সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থান একত্রিত করার মোক্ষম অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।’ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বলেছেন, বঙ্গার অভিজ্ঞতা তাকে চূড়ান্ত দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সংস্থাকে কার্যকরভাবে বিকশিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো অনুসরণ করার সময়, অংশীদারত্বের সমৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্যগুলো অর্জনে সহায়তা করবে। এর মধ্যে জলবায়ু অভিযোজন এবং অভিবাসন কমানোর জন্য উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অন্যতম। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষদের জয়জয়াকার এখন দুনিয়া স্বীকৃত। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক, আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের পর এবার সংবাদে এলেন অজয় বঙ্গা। ছবি দেখেই আঁচ করা যায় তিনি শিখ ধর্মাবলম্বী। শিখদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী আমলে ব্যাপক মতান্তর ও সহিংসতা হয়েছিল ভারতে। আমরা তখন যৌবনে। যেদিন ইন্দিরা গান্ধী মারা যান আমি তখন বনগাঁ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কলকাতার পথে। কলকাতার মতো কিছু নগরী আর সাউথ ইন্ডিয়া বাদ দিলে উত্তর ভারতে শিখবিরোধী নির্যাতন-হত্যা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন যখন আমি বহুজাতিক একটি দেশে বসবাস করি এবং প্রচুর শিখের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আমি এ কথা বলতেই পারি কংগ্রেস ন্যায় করেনি। বিদ্রোহ বা তাদের আন্দোলনকে বিপথগামিতা থেকে বাঁচাতে অন্য পথ হয়তো নেয়া যেত। সে যাই হোক আমি শিখদের স্যালুট জানাই এরপরও তারা ভারতের সঙ্গে থেকে গণতান্ত্রিক জীবনচর্চা করছেন। আজকে শিখ ও ভারতবর্ষ একাকার। যে ইতিহাস বা যে উদারতা আমাদের নেই। কারণ শিখ দেহরক্ষীর হাতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলেও কংগ্রেস মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে দ্বিধা করেনি। অজয় বঙ্গ নতুন প্রজন্মের শিখ, যিনি নরেন্দ্র মোদির অনুগামী বলেও সুপরিচিত। বিশ্বব্যাংকের পরিধি বা কার্যক্রম আমাদের অজানা নয়। বিশ্বব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা সংস্থা, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ঋণ ও অনুদান প্রদান করে। বিশ্বব্যাংকের অনুষ্ঠানিক লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন। সারা বিশ্বের ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এর প্রধান সদর দপ্তর ওয়াশিংটন, ডি সি। এই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ও নাজুক হয়ে গেছে। পদ্মা সেতু নিয়ে যে বিরোধ তার দায় একা সরকারের নয়। আবার এটাও সত্য বিশ্বব্যাকের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বৈরিতাও ঠিক না। এবং সেটা সম্ভবও না। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্ক আবার ঠিক করার কাজটা কি এবার শুরু হবে? বলছিলাম মেধা দিয়ে বিশ্বজয়ের গল্প। ভারতীয়দের দেখুন তারা তাদের পথ ঠিক করে এগোয়। আমি সিডনিতে কোনো ভারতীয় পাইনি যিনি কংগ্রেস, বিজেপি বা মমতাকে নিয়ে বাহাস করেন। বরং কোনো কোনো ঘরোয়া আড্ডায় মমতার বিরুদ্ধে কথা বললে তারা নাখোশ হন। তাদের কথা একটাই এটা আমাদের ব্যাপার। আমরা সামলাব। আত্মসম্মান আর মর্যাদার এই ধারা আমরা অনুসরণ করি না। বিদেশে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বন্ধুর যেমন কমতি নেই তেমনি খালেদা জিয়া বা বিএনপি-জামায়াতেরও রমরমা। বরং এরা সংখ্যায় বেশি। এদের কথাবার্তা আর চিন্তা-ভাবনা এখনো মান্ধাতার আমলের মতো। এদের কথা শুনলে মনে হবে সরকারের ভিত্তি কচুগাছের মতো নড়বড়ে। আপনি যদি ইউটিউব বা ডিজিটাল মিডিয়ায় চোখ রাখেন আপনার মনে হতে পারে বাংলাদেশে নেই কিছু নেই। পানি, খাবার, বিদ্যুৎ এমনকি মানুষজনও নেই। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে এসব অনুষ্ঠান আলতু ফালতু ভিডিও ক্লিপের সংযোজন বাংলাদেশিদের একমাত্র বিনোদন এখন। অবাক হবেন খেটে খাওয়া পরিবারঅন্তপ্রাণ বাংলাদেশিরা এসবে কম থাকেন। আছেন তথাকথিত মেধাবী পিএইচডিধারী আর অলস কিছু মধ্যবয়স্ক মানুষ। তাদের মগজে জিন্নাহ, জিয়াউর রহমান, গোলাম আযম। অন্যদিকে আরেক দল যেভাবে পারে বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে চলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থ কামানোর ধান্ধায় এদের মতো লীগার আর কেউ নেই। এসব ডামাডোলে আমাদের আসল কাজ পথ হারিয়েছে অনেক আগে। যেসব বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী পাঠ নিতে বিদেশে আসে তাদের বেশির ভাগই এক সময় নোংরা দেশজ রাজনীতির খপ্পরে পড়ে যায়। দল-মত বা বন্ধুদের চাপে বা দেশের সমাজ ও বিদেশের সমাজের কারণে তাদের পথ বদলে যায়। যেখানে গবেষণা করে নিজেকে প্রস্তুত করে বিশ্বে মাথা তোলার কথা সেখানে ভয়ংকর প্রচারণার শিকার হয়ে পড়ে। ভারতীয় এমনকি নেপালিরাও এখন নিজেদের তৈরি করতে মরিয়া। অথচ আপনি দেখেন এত বছর বিলেতে বসবাসের পর আমরা পেলাম শামীমা নামের এক নারী। যে স্বেচ্ছায় জঙ্গি হয়ে গেয়েছিল। এখন বিলেতের নাগরিকত্ব ফেরত চাইলেও পাচ্ছে না। তাকে বাংলাদেশও নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের এই জঙ্গিবিরোধী নীতি প্রশংসার দাবিদার। যেসব তথাকথিত শিক্ষিত বাংলাদেশি বিদেশে মানবাধিকারের নামে এগুলো জায়েজ করাতে চায় তারা তাদের নিজেদের বেলায় কিন্তু‘ ঠিক তার উল্টো। তাদের সন্তানরা বিদেশে উচ্চ ডিগ্রিধারী আর রাজনীতিমুক্ত। পরের বেলাব এরা মারাত্মক সহানুভূতিশীল। এসব চাপে আমাদের তারুণ্যে জাগার সম্ভাবনা ক্রমেই বিলীন হয়ে পড়ছে। জাগার অর্থ আসলে কী? দেশের বাইরে আওয়ামী-বিএনপি না করে সেসব দেশের মূলধারায় মেশা। আমি বাংলাদেশে যৌবন কাটিয়ে এসেছি। আমার মধ্য বয়সের এক পর্ব কেটেছে দেশে। আমি বিদেশে বসবাস করলেও আমরা ইংরেজি তাদের মতো না। আমার সাধ্য নেই তাদের সংস্কৃতি ক্লাব কালচার বা মূলধারা বজায় রাখার। অথচ সন্তানরা পারে। অনায়াসে পারে। কাজেই তাদের তো সে সুযোগ দেয়া উচিত যাতে তারা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারে। ভারতীয়রা সে টার্গেট নিয়ে এগোয় বলেই তাদের প্রজন্ম আজ শীর্ষে। এভাবে একদা ইহুদিরা দখল নেয়ায় আজ অবদি তাদের সেরা জায়গা থেকে নামানো সম্ভব হয়নি। কেবল বিরোধিতার জন্য ভারত বিরোধিতা করি আমরা। অথচ আমাদের এসব খবর থেকে পাঠ গ্রহণ করা কর্তব্য। আমি কাজ করতে গিয়ে দেখেছি এবং বিশ্বাস করি বাংলাদেশিদের মেধা বা কাজের ধারা আন্তর্জাতিক মানের। চাইলেই আমরা পারি। পারি বলেই আমাদের কিছু কিছু মানুষ এখন তেমন মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বে শীর্ষে আছেন। কিন্তু যেটা নেই তা হলো সমঝোতা আর নিবিড় দেশপ্রেম। নেই বাংলাদেশের স্বার্থে সবাই এক হওয়ার স্বপ্ন বা সাধনা। থাকলে আমরাও ভারতীয়দের মতো পারতাম। পাকিস্তানিদের অবস্থা দেখলে ভীত হওয়ার বিকল্প থাকে না। এককালে সমানে সমন হলেও এখন তারা ইন্ডিয়ানদের তুলনায় নগণ্য। আমরা যেন সে পথে না হাঁটি। বাংলাদেশের জন্য অজয় বঙ্গার এই পদ আশীর্বাদ হয়ে উঠুক। পাশাপাশি আমরাও যেন তৈরি হই এভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় হয়ে ওঠার। তা না হলে সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে। আমাদের এত সব অর্জন আর ইতিহাস অতীত হয়ে থাকবে। যে কোনো বড় জাতিসত্তার প্রথম কাজ হচ্ছে বিদ্যা আর মেধার বিস্তার। আজকের বাংলাদেশে যে পরিমাণ অর্থবিত্ত সে পরিমাণ মেধার স্ফুরণ নেই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত মেধা আর মননের দুয়ার খোলা এখন সময়ের চাহিদা।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App