×

মুক্তচিন্তা

জলাতঙ্ক বনাম জ্বালাতঙ্ক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০৯ এএম

মাস কয়েক আগে রাস্তার একটা পাগলা কুকুর আমার পায়ে কামড় দিয়েছিল। পাগলা কুকুর মানুষকে কামড়ালে জলাতঙ্ক রোগ হয়, তাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য আমি দ্রুত নিকটবর্তী একটি হাসপাতালে জরুরি বিভাগে যাই। অতি যতœ ও দ্রুততার সঙ্গে আমার চিকিৎসাসেবা শুরু হয়। প্রথমে সাবান দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা হয়। পরে এন্টির‌্যাবিস ইনজেকশনসহ কয়েক ধরনের ইনজেকশন পুশ করা হয়। ডাক্তার বললেন, পরে আরো কয়েকটি ইনজেকশন দিতে হবে। ডায়াবেটিস রোগ হওয়ার কারণে আমাকে প্রতিদিন নিয়ম করে এক ঘণ্টা হাঁটতে হয়। সেদিন নির্জন রাস্তায় হাঁটছি, এমন সময় হঠাৎ একটি কুকুর রাস্তার বিপরীত দিক থেকে এসে আমার ডান পায়ের গোড়ালির কাছে একটা কামড় দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। কুকুর পাগল না হলে সাধারণত মানুষকে কামড়ায় না। কুকুরকে কেউ ‘হুঁশের পাগল’ বলে তার পাগলামি বা কামড়ের গুরুত্ব কমাতে চায় না। কিন্তু ‘হুঁশের পাগলরা’ অকারণেও মানুষকে জ¦ালাতন করে। কুকুরের দংশন বিষয়ক শৈশবে পড়া কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত ‘উত্তম ও অধম’ শীর্ষক কবিতার অংশবিশেষ মনে পড়ল ‘কুকুর আসিয়া এমন কামড় দিল পথিকের পায়, কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে বিষ লেগে গেল তায়।’ ঘরে ফিরে এসে পথিক তার কন্যাকে ঘটনাটি জানালে কন্যা বলে, ‘তুমি কেন বাবা ছেড়ে দিলে তারে, তোমার কি নাই দাঁত? কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল, তুইরে হাসালি মোরে, দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়ে দংশি কেমন করে? কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে কামড় দিয়েছে পায়, তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে মানুষের শোভা পায়?’ কুকুরকে ক্ষমা করে দিলাম। অক্ষমরা কেবল ক্ষমা করতেই জানে। আসলে আমি মানুষ তো। কুকুরের স্বভাব মানুষের মধ্যে থাকতে নেই। তা না হলে মানুষে আর কুকুরে তফাত কী? খবরে প্রকাশ, বিএনপির মহাসচিব পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার খায়েশ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এর চেয়ে পাকিস্তান অনেক ভালো ছিল।’ সরকার তাকে করারুদ্ধ করায় দেশের বিশিষ্ট ৬০ জন বুদ্ধিজীবী তার মুক্তি দাবি করে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। (এর কয়েক দিন পর আমার ছোট বোনকে বাসার গৃহ-পরিচারিকা হঠাৎ পাগল হয়ে কামড় দিয়েছিল। ডাক্তার বলেছে, পাগলা কুকুরের কামড়ের চেয়ে পাগল মানুষের কামড় বিপজ্জনক।) বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মির্জা ফখরুল দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে রাজনীতি করছেন। আমরা মির্জা ফখরুলের বন্ধু ও শুভাকাক্সক্ষীরা তার সুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী ও বেগবান করার জন্য আমরা মির্জা ফখরুলের মুক্তি দাবি জানাচ্ছি (প্রথম আলো, ৩০. ১২. ২২) কোনো বন্দির মুক্তি দাবি করে বিবৃতি দেয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যিনি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে পাকিস্তানে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন, পাকিস্তান যার আরাধ্য বাসভূমি, শ্রদ্ধেয় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা তাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর দাবি করে বিবৃতি দিলে শোভন হতো। সেটাই তাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল। পাকিস্তান আমাদের বাবু রাষ্ট্র নয়। যে দেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার জন্য ৩০ লাখ লোক প্রাণ দিয়েছিল, ২ লাখ মতান্তরে ৬ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছিল সে দেশের কোনো নাগরিক বিশেষ করে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা শত্রæর দেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে পারেন তা ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়। তার চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই হুঁশের পাগলের মুক্তি দাবি করে ৬০ জন দেশপ্রেমিক এবং প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবী সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়েছেন। ভদ্রতার খাতিরে উক্ত ব্যক্তিকে স্বাধীনতাবিরোধী না বলে ‘হুঁশের পাগল’ বললে তার অবমূল্যায়ন করা হবে না। কেননা, তিনি বাস করেন বাংলাদেশে, আর প্রশংসা করেন শত্রæর দেশ পাকিস্তানের! বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সেনাশাসক জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘রাজনীতিকে আমি রাজনীতিবিদদের জন্য দুঃসহ করে তুলব।’ একই সিদ্ধান্ত যদি বর্তমান সরকার নেয়, তাকে দোষ দেয়া যায় না। জিয়ার দল আজ বুমেরাং হয়েছে। কুকুর কত কারণে পাগল হয় জানি না, কিন্তু মানুষ যে অনেক কারণে পাগল হয় এটা সকলে জানে। ‘হুঁশের পাগল’ তার অন্যতম। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন দিন পাগলের সংখ্যাও বাড়ছে। অনেক পাগলের চিকিৎসা থাকলেও হুঁশের পাগলের কোনো চিকিৎসা নেই। হুঁশের পাগলরা বেশির ভাগ ক্ষমতার লোভে পাগল হয়, সেটা বৈধভাবে হোক আর অবৈধভাবে হোক। ক্ষমতা পেলে তাদের রোগ সেরে যায়। তাদের জন্য অন্য চিকিৎসার দরকার হয় না। তাদের মুক্তির জন্য কোনো বিবৃতিরও প্রয়োজন পড়ে না। বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন বা বিবৃতি আদায়ে বিএনপির কৌশল দেখে শক্তিহীন বৃদ্ধ সিংহের গল্প মনে পড়ে। পশুরাজ সিংহ শক্তিহীন হয়ে পড়েছেন। সে বৃদ্ধ, পূর্বের মতো আর শিকার ধরতে পারে না। তাই বেঁচে থাকার জন্য সে একটি কৌশল নিয়েছে। গুহার ভেতর বসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে পশুদের আমন্ত্রণ জানায়। তার মিষ্টি কথায় তুষ্ট হয়ে কোনো পশু কাছে এলেই সে তার ঘাড় মটকে ধরে। বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশে সুপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে। আজকের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরই উত্তরসূরি। শহীদ পূর্বসূরিদের প্রতি বর্তমান প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীদের সহানুভূতি, সহমর্মিতা থাকবে না, এ কথা ভাবা যায় না। এক সময় যাদের হাতে বর্তমান প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীদের পূর্বসূরিরা শহীদ হয়েছিলেন, সেই হত্যাকারীদের উত্তরসূরিদের সঙ্গে তাদের সহমর্মিতা দেখে ঘৃণায়, লজ্জায় মুখ লুকাতে ইচ্ছা করে। এদেরই অনেকের লেখায়, বক্তৃতায় বর্তমান প্রজন্মের দেশপ্রেমিকরা জনসেবায় অনুপ্রাণিত হয়। তারা সুনাগরিক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। স্বাধীনতাবিরোধীদের অপকৌশলে আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা তাদের শিকারে পরিণত হন, বিতর্কিত হন। তাদের আদর্শের ব্যাপারে সচেতন নাগরিকদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়। সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতার জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না। বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করা কোনো সুস্থ বুদ্ধিজীবীর কাছে কাম্য নয়। সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীরা তাদের আদর্শের ব্যাপারে সর্বদা অনড় থাকেন। আদর্শের সঙ্গে তারা কখনো আপস করেন না। এ কারণে তারা শত্রæ-মিত্র সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। সাময়িক লাভ বা সুবিধার জন্য তারা কখনো আদর্শচ্যুত হন না। তাদের খেয়াল করা উচিত, তারা যাদের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন তারা কখনো আমাদের অর্জিত অহংকার- ‘জয়বাংলা’, ‘জয়বঙ্গবন্ধু’ বলে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। স্বাধীনতাবিরোধীরা গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের মুখোশ পরে তাদের গণতন্ত্র হত্যাকারী পূর্বসূরিদের ন্যায় দেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। তাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তা, আচরণ এবং পদ্মা সেতুসহ সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা তারই সাক্ষ্য বহন করে। যারা কেবল হতাশার কথা বলে তারা দেশে বিপর্যয় ডেকে আনে। ‘হুঁশের পাগলদের’ শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও স্বাধীনতা-পরবর্তী গত ৫০ বছরে ২০২২ সালের মতো মাত্র এক বছরে এত সাফল্য আর আসেনি। (হাজার কোটি টাকা বিদেশে অবৈধভাবে পাচার হওয়া সত্ত্বেও।) এককালে রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুর দেখলে পৌরসভার কর্মীরা তাদের হত্যা করত। পরবর্তীকালে ‘কুকুরপ্রেমীদের’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে কুকুর নিধন বন্ধ হয়ে যায়। এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বর্তমান সরকার দেশের স¦াধীনতা বিরোধীদের প্রতিও নমনীয় আচরণ করতে শুরু করে। কুকুর এখনো মানুষকে কামড়ায়। স্বাধীনতা বিরোধীরাও গণতন্ত্রের মুখোশ পরে তথাকথিত গণতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। তারা স্বাধীনতার পক্ষশক্তি হিসাবে পরিচিত কতিপয় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর সাহায্য, সহানুভূতি ও সমর্থন পায় কেমন করে? গণতন্ত্রের হত্যাকারীরা যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে পাগল হয় তখন তাদের হুঁশের পাগল ছাড়া আর কী বলা যায়? গণতন্ত্র হত্যাকারীদের বশংবদ বা অনুসারীরা যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয় তাদের ‘হুঁশের পাগল’ ছাড়া আর কী বলা যায়! আমার বিবেচনায় কোনো বুদ্ধিজীবী কখনো ‘হুঁশের পাগলদের’ সমর্থক হতে পারেন না। পাগলা কুকুর কামড়ালে জলাতঙ্ক রোগ হয়। তাতে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাগল বা হুঁশের পাগলে কামড়ালে ‘জ্বালাতঙ্ক’ রোগ হয়। জনগণের গায়ে জ¦ালা ধরিয়ে দেয়। তাতে গোটা জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা সারা দেশকে জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে। শয়তানের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করা যায় কিন্তু ‘হুঁশের পাগলের’ সঙ্গে বাস করা যায় না। শয়তানের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়, কিন্তু হুঁশের পাগলের ক্ষমতা আন্দাজ করা যায় না। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আনপ্রেডিকটেবল’। চিকিৎসা শাস্ত্রে পাগলের চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু হুঁশের পাগলের কোনো চিকিৎসা নেই। একটি গল্প দিয়ে শেষ করছি। এক আলুর গুদামে আগুন লাগায় লোকজন পানি দিয়ে তা নিভানোর চেষ্টা করছে। পাশে বসে এক লোক পোড়া আলু খাচ্ছে আর বলছে, ‘আবার কবে গুদামে আগুন লাগবে?’ এ লোক হচ্ছে হুঁশের পাগল। আসল পাগল থেকে হুঁশের পাগলদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য হুঁশের পাগলদের গলায় পাগলা কুকুরের ন্যায় গলাবন্ধনী রাখা দরকার।

শাহ্জাহান কিবরিয়া : শিশু সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App