×

সারাদেশ

কুয়াকাটাগামী পিকনিকের বাসে বাড়তি টোল আদায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৩ এএম

কুয়াকাটাগামী পিকনিকের বাসে বাড়তি টোল আদায়

ফাইল ছবি

কুয়াকাটায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত পর্যটকদের পিকনিক পার্টির রিজার্ভ বাস থেকে কলাপাড়া-কুয়াকাটা মহাসড়কের তিনটি সেতু পারাপারে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত টোল আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। টোল ইজারাদারের লোকজন রাতে বাস চালকদের জিম্মি করে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত টোল আদায় করে থাকে। প্রতিবাদ করলে বিভিন্ন রকমের ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে চালকদের টাকা দিতে বাধ্য করে এবং অশ্লীল ব্যবহার করে থাকে। এমনকি অতিরিক্ত টাকা উল্লেখ করা রসিদও প্রদান করে। হয়রানির শিকার হয়ে বাসচালক ও পর্যটকদের মধ্যে দিন দিন ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। প্রতারিত হয়ে গন্তব্যে ফিরে যাচ্ছেন পর্যটকরা। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে পর্যটন শিল্পে।

জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ৭৪ কিলোমিটার। কলাপাড়া উপজেলা সদর থেকে কুয়াকাটা যেতে ২১ কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি নদীর ওপর তিনটি সেতু রয়েছে। ঢাকা-পটুয়াখালী কুয়াকাটা মহাসড়কের কলাপাড়া শহর সংলগ্ন আন্ধারমানিক নদীর ওপর শেখ কামাল সেতু, হাজিপুর সোনাতলা নদীর ওপর শেখ জামাল সেতু ও শিববাড়িয়া নদীর ওপর শেখ রাসেল সেতু।

চালক ও সুপারভাইজারদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে টোল রশিদে দেখা যায়, গত ২০ জানুয়ারি শেখ কামাল সেতুর রসিদে একটি বড় বাসের (চেয়ারকোচ) ভাড়া ১৮০ টাকার স্থলে রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। ২১ তারিখ একই বাস গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার সময়ও রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। একইভাবে শেখ জামাল সেতুতে ৯০ টাকার স্থলে ভাড়া রাখা হয়েছে ১৮০ টাকা। গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার সময় আবারো ১৮০ টাকা রাখা হয়েছে। শেখ রাসেল সেতুতে ৯০ টাকার স্থলে একইভাবে ১৮০ টাকা রাখা হয়েছে। খুলনার কয়রা থেকে মিনিবাস নিয়ে আসা চালকের অভিযোগ, তার মিনিবাসেও শেখ কামাল সেতুতে ১০০ টাকা ভাড়া নির্ধারিত থাকলেও আদায় করা হয়েছে ২৫০ টাকা। আর শেখ জামাল ও রাসেল সেতুর ৫০ টাকার স্থলে ১৮০ টাকা রাখা হয়েছে।

চালক ও সুপারভাইজারের অভিযোগ, সিন্ডিকেট করে তিনটি সেতুর টোল আদায় করে থাকে ইজারাদাররা। এমনকি পুলিশ সদস্যরা ডিউটিতে থাকলেও তর্ক-বিতর্ক শুনে না দেখার ভান করে অন্যদিকে চলে যান তারা।

খুলনা জেলার কয়রা থেকে রিজার্ভ বাস নিয়ে কুয়াকাটায় আসা চালক মো. শাহিন জানান, গত ২০ জানুয়ারি ভোর রাতে কুয়াকাটায় আসার সময় কলাপাড়া থেকে কুয়াকাটা পৌঁছতে শেষ তিনটা সেতুর টোল দিতে গিয়ে অনেক তর্ক

বিতর্ক হয়েছে। তিনি বলেন, টোলঘরে তাদের চাহিদামতো অতিরিক্ত টোল দিতে না চাইলে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করে থাকে। হাজিপুর শেখ জামাল সেতু ও মহিপুর শেখ রাসেল সেতুর নির্ধারিত ৫০ টাকার টোল ১৮০ টাকা রাখছে। আর শেখ কামাল সেতুর নির্ধারিত ১০০ টাকার টোল দিতে হয়েছে ২৫০ টাকা। এত বেশি টোল কেন জিজ্ঞাসা করলে ওরা বলে ভাড়া এইটাই। না হলে তুমি ব্রিজ পার হইয়া এপাড়ে আইছো কেন? ব্র্রিজ পার হইয়া ব্যাকে যাও। তিনি আরো জানান, এভাবে অতিরিক্ত টোল আদায় করলে মালিক-মহাজনরা ব্যবসা করতে পারবে না। ভাড়াতো এইটা না, আসলে আমরা যেটা হিসাব করে মহাজনের কাছ থেকে নিয়ে আসি সেটাই ভাড়া। ভাড়া যদি বেশি দিতে হয় তাহলে আমাদের বেতন থাকে না। আমাদের পকেট থেকে টোল দিতে হবে। অভিযোগ করে চালক আরো বলেন, তারা (ইজাদাররা) যেটা চাইবে সেটাইতো দেয়া লাগবে। দূর-দূরান্ত থেকে আসছি। যদি আমার গাড়িটা আটকাইয়া দেয় তাইলে পার্টিরাতো বুঝবে না। তাই বাধ্য হয়ে দিতে হচ্ছে।

চাঁদপুর থেকে রিজার্ভ চেয়ার কোচ নিয়ে আসা তিশা পরিবহনের সুপারভাইজার মো. জসিম বলেন,পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আমি পার্টি নিয়ে কমপক্ষে ১০ বার কুয়াকাটা গেছি। বিশেষ করে বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার পিকনিক পার্টি রিজার্ভ নিয়ে কুয়াকাটায় যাই। এছাড়াও সরকারি ছুটি কিংবা যে কোনো উৎসবের টানা ছুটিতে রিজার্ভ বাস নিয়ে আসি কুয়াকাটায়। দেশের সব প্রান্তেই বাস নিয়ে যাই। দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত টোলের অতিরিক্ত আদায় করতে দেখিনি। কলাপাড়া শহরের পর তিনটি নদীর ওপর টোল আদায় করছে ইচ্ছামতো। চেয়ারকোচে ১৮০ টাকা নির্ধারিত ভাড়া, নিচ্ছে ২৫০ টাকা। শেখ জামাল ও রাসেল সেতুতে ১০০ টাকার স্থলে নিচ্ছে ১৮০ টাকা। প্রতিবাদ করলে তারা গালমন্দ করে জোরপূর্বক টাকা হাতিয়ে নেয়। আবার অতিরিক্ত টাকার রসিদও দিচ্ছে। টোলের লোকজন বলে আসলে আসেন, নাইলে ঘুরাইয়া চলে যান। আপনাদের আসা লাগবে না। এখানে লাউকাঠী নদীর ওপর পটুয়াখালী সেতুর টোল ঘরে ভাড়া বেশি নেয় না, ১৩৫ টাকা নেয় ঠিকই। কিন্তু রাতে তারা পৌরসভার টোল বাবদ ১০০ টাকা করে আদায় করে থাকে। পর্যটক সোহাগ রহমান বলেন, কুয়াকাটা যাওয়ার পথে রাত সাড়ে ৩টার দিকে চালক ও সুপাভাইজারের সঙ্গে টোল কর্তৃপক্ষের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায়। এগিয়ে শুনতে পাই অতিরিক্ত টোল চাওয়ায় বাসের চালক ও সুপারভাইজারের সঙ্গে ইজাদারের লোকজনের কথাকাটাকাটি হচ্ছে। টোল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, পিকনিক পার্টির বাসে এই হারেই টোল দিতে হবে। না হলে বাস ঘুরিয়ে গন্তব্যে চলে যাও। কেন উঠেছ ব্রিজে।

ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশনস্ অব কুয়াকাটা (টোয়াক) সাধারণ সম্পাদক বলেন, সপ্তাহের সরকারি ছুটির দিনগুলোতে শতাধিক পিকনিক পার্টির বাস আসে কুয়াকাটায়। কোনো কোনো শুক্রবার তারও বেশি পিকনিক পার্টি আসে। সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে যদি সেতুর টোল বেশি আদায় করা হয় সেটা প্রথমত পর্যটকদের হয়রানির একটা অংশ। দ্বিতীয়ত কুয়াকাটার প্রতি পর্যটকদের একটা বিরূপ ধারণা তৈরি হবে। কোথাও প্রবেশের পথেই যদি বাধা আসে তাহলে পুরো ট্যুরটাই তার নষ্ট হয় বা মানসিক অবস্থা ভালো থাকে না।

তিনি আরো বলেন, সরকারি যে ভাড়াটা নির্ধারিত আছে সেটা নিতে পারে। কমতো আর নিতে পারবে না। কিন্তু সেটা (টোল) নেয়ার পাশাপাশিও ভালো ব্যবহার আসা করতে পারেন ট্যুরিস্টরা। সেটা না করে যদি বেশি ভাড়া আদায় করে তাহলে দুদিকেই আমাদের জন্য খারাপ। একদিকে পর্যটকের সঙ্গে আমরা বিরূপ আচরণ করছি, আর দ্বিতীয়ত কুয়াকাটার প্রতি তার একটা খারাপ ধারণা তৈরি হবে। ব্যাক করার পরে সে কুয়াকাটার প্রতি পজেটিভ প্রচার করবে না। এটা আমাদের জন্য একবারে একটা দুঃসংবাদ। যে কোনোভাবেই হোক প্রশাসনিক অথবা যে কোনো কাঠামোতেই হোক এটা বন্ধ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।

শেখ রাসেল সেতুর ইজারাদার মেসার্স খান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবুল বাশার বলেন, অতিরিক্ত টোল আদায় করার বিষয়টি তার জানা নেই। তবে আমার লোকজনকে বলে দিয়েছি কারো কাছ থেকে একটি টাকাও বাড়তি নেবে না। আপনি বলছেন আমি বিষয়টি দেখছি।

শেখ জামাল সেতুর ইজারাদার মেসার্স রফিক এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মো. জুয়েল হাসান বলেন, বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি। পর্যটকদের সঙ্গে খারাপ আচরণের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা মোটেই সত্য নয়। আপনাকে যারাই বলেছে সেটা মিথ্যা বলেছে। কারণ আমার লোকজনকে আমি বলে দিয়েছি কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ করবা না।

শেখ কামাল সেতুর ইজারাদার নাজমুস সায়াদাত বলেন, আমিতো টোলে অনেক দিন ধরে যাই না। খোঁজ খবর নিয়ে দেখছি বিষয়টা কি?

কুয়াকাটা পৌর মেয়র মো. আনোয়ার হাওলাদার বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরাসহ প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার পিকনিক পার্টির পর্যটকরা বাস নিয়ে কুয়াকাটায় ঘুরতে আসেন। পর্যটকবাহী বাসে অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়ে আমাকে কেউ জানায়নি। এটা আমার আওতার বাইরে। তবে পর্যটকরা আমাদের মেহমান। টোলের ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। যদি এর বাইরে কোনো ইজারাদার বা তার লোকজন বেশি ভাড়া আদায় করে তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

এ বিষয়ে পটুয়াখালী সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী এ এম আতিক উল্লাহ বলেন, টোলের ইজারাদাররা সরকারি নিয়ম কানুন মেনেই স্বাক্ষর করে ইজারা নিয়ে থাকেন। প্রত্যেক টোলপ্লাজায় নির্ধারিত মূল্য তালিকা উল্লেখিত বোর্ড টাঙ্গানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর যদি কোনো ব্যত্যয় হয় বা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে থাকে তাহলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমনকি ইজারা বাতিল পর্যন্ত করা হবে।

কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়টি তার জানা ছিল না। নির্ধারিত টোল আদায়ের বাইরে যদি কোনো ইজারাদার অতিরিক্ত টোল আদায় করে থাকে তবে তা খতিয়ে দেখে সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলীকে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App