×

জাতীয়

দূষিত শহরের তালিকায় কেন বারবার শীর্ষে ঢাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৩০ এএম

দূষিত শহরের তালিকায় কেন বারবার শীর্ষে ঢাকা

ছবি: ভোরের কাগজ

৩১৭ দিনই খারাপ বায়ু! দূষণের পরিমাণ বাড়ছে বছরে ১০ শতাংশ উপেক্ষিত আদালতের ৯ দফা

নিঃশ্বাসে বিষ! প্রতিটি নিঃশ্বাসে বিষাক্ত বায়ু নিচ্ছে রাজধানীবাসী। দূষিত শহরের তালিকায় আবারো শীর্ষে থাকা ঢাকার বায়ুমানের অবনতি হয়ে গতকাল শুক্রবার তা বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ৩৩৫ স্কোর নিয়ে আইকিউ এয়ারের তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে রাজধানী শহর। এ তালিকায় ২৫৮ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের মতে, ঢাকার বায়ুদূষণের পরিমাণ বাড়ছে বছরে ১০ শতাংশ। আর বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়ামের গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতকালে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকছে। শীতকালে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি থাকে সবচেয়ে খারাপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্মল বায়ুর মানমাত্রার চেয়ে ৩১৭ দিনই খারাপ থাকে রাজধানীর বাতাস।

মূলত, একিউআই স্কোর ১০০ থেকে ২০০ পর্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত হয়; বিশেষ করে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য। একইভাবে একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরি অবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। ৩০১ থেকে ৪০০ একিউআই স্কোরকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। আইকিউ এয়ারের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে ঢাকার বায়ু ছিল অস্বাস্থ্যকর বা খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়। প্রায় প্রতিদিনই দূষিত বায়ুর তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।

কেন বারবার শীর্ষে ঢাকা : বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি ধরনকে ভিত্তি করে; যেমন-বস্তুকণা (পিএম ১০ ও পিএম ২ দশমিক ৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘হেলথ অ্যাফেক্টস ইনস্টিটিউট’ এবং ‘ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স এন্ড ইভ্যালুয়েশন’ বায়ুর মানের দিক থেকে এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল বলে ঘোষণা দিয়েছে। আর বাংলাদেশকে তার শীর্ষে রেখেছে। এদিকে দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় কেন বারবার শীর্ষে অবস্থান করছে ঢাকা- এই প্রশ্নে প্রতি বছরই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রতিকারের জন্য সুপারিশমালাও প্রণয়ন করা হচ্ছে। তবে প্রতিকারের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।

পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস- ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলাবালি। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের জন্য ২০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণগুলো হচ্ছে- ইটভাটা, রাস্তা নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও মেরামত, সেবা সংস্থাগুলোর নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বড় উন্নয়ন প্রকল্প (এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল), সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, সড়ক বা মহাসড়কের পাশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বালু উত্তোলন ও সংগ্রহ, ট্রাক বা লরিতে বালু, মাটি, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় পরিবহন, রাস্তায় গৃহস্থালি ও পৌর বর্জ্য স্তূপাকারে রাখা ও বর্জ্য পোড়ানো, ড্রেন থেকে ময়লা তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা, ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে গিয়ে ধুলাবালি ছড়ানো, বিভিন্ন সড়কের পাশে থাকা অনাবৃত স্থান, ফুটপাত ও রাস্তার আইল্যান্ডের মাঝের ভাঙা অংশের

মাটি ও ধুলা, ফিটনেসবিহীন পরিবহন থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর ধোঁয়া, বিভিন্ন যানবাহনের চাকায় লেগে থাকা কাদামাটি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি কলোনির ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো, বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক ভবনের আবর্জনা ও ধুলাবালি রাস্তায় ফেলে দেয়া, ঢাকা শহরের দূষণপ্রবণ এলাকার ধুলা, হাসপাতালের বর্জ্য রাস্তায় ফেলা, অধিক সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহার এবং জনসচেতনতার অভাব। এ ব্যাপারে বাপার (পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ভোরের কাগজকে বলেন, গত দশ বছরে এই কনস্ট্রাকশন কাজ অনেক বেড়েছে। ইট বালু সুরকির কাজ চলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিধিবিধান না মেনেই। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এসব থেকে দূষণ হচ্ছে। গাড়ির কালো ধোঁয়া মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করছে। ভালো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। শীতকালে ইটের ভাটায় দূষণ বেড়ে যায়। কলখারখানায় দূষণ বেশি হয়। বর্জ্য থেকেও দূষণ হচ্ছে। মিথেন গ্যাস হচ্ছে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। সঠিকভাবে দায়িত্ব চিহ্নিত করতে পারছি না। বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দায়িত্বপালন সঠিক হচ্ছে না। এটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।

গবেষণা অনুযায়ী, বছরের অর্ধেক সময় ঢাকার সবচেয়ে দূষিত বায়ু থাকে শাহবাগ এলাকায়। বর্ষায় সবচেয়ে দূষিত বায়ু মিরপুরের। বর্ষার পরের সময়টাতে তেজগাঁওয়ে বাতাস সবচেয়ে দূষিত থাকে। দূষণ রোধে সরকারি সংস্থার অবহেলা সবচেয়ে বেশি দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে খোদ সরকারি সংস্থাগুলো বায়ুদূষণ করছে।

জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, দূষণের যে কারণগুলো, সেই কারণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে জাতীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত, সেই পদক্ষেপগুলো নেয়া হয় না। বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলো হচ্ছে- ছোট বড়, সরকারি বেসরকারি নির্মাণ প্রকল্প, প্রতিটি প্রকল্প পরিবেশকে রক্ষার জন্য এনভায়রমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান জরুরি। কিন্তু ছোট থেকে বড়, মিনি থেকে মেগা কোথাও এই প্ল্যান নেই। ফলে দূষণের বিস্তার ঘটে। দ্বিতীয়ত. গাড়ির কালো ধোঁয়া। তিনি বলেন, যানগুলোর ফিটনেস রয়েছে কিনা, এটি দেখা হয় না। অন্যদিকে কতটা সিসা থাকে, তার ওপর নির্ভর করে ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, এগুলোর ক্যাটাগরি করা হয়। বাংলাদেশে জ¦ালানি তেলে সিসার পরিমাপ আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক বেশি। ফলে বেশি দূষণ ঘটে। এর বাইরে ঢাকার চারপাশে মালার মতো ঘিরে থাকা যে ইটভাটা, সেখান থেকে সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটে। অন্যদিকে নগরীর ভেতরে নানারকম ছোট বড় শিল্পকারখানা রয়েছে, সেগুলোর বর্জ্য বাতাসকে দূষিত করে। ব্যক্তিগত অফিসের বর্জ্য, সরকারি অফিসের বর্জ্য- এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক কোনো পরিকল্পনা নেই। এসব থেকেই দূষণ ছড়ায়। এর মানে কী? এই যে দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করার পরও দুয়েকটি জায়গা ছাড়া কোথাও কোনো পরিকল্পনা হয়নি। কোনো উৎস বন্ধ হয়নি। কোনো নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আর নেয়া হয়নি বলেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। আমরা প্রায় প্রতিদিনই দূষণের শীর্ষে থাকি। আমরা একটি দুঃখজনক অবস্থানে রয়েছি, যা থেকে বের হতে পারছি না। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ বেশি জরুরি। বিগত কয়েক বছর ধরে দেখছি, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে কাজটি করেন, সেটি হয়। তা না হলে হয় না।

উপেক্ষিত হাইকোর্টের ৯ দফা : হাইকোর্টের ৯ দফার মধ্যে ঢাকা শহরে মাটি/বালু/বর্জ্য পরিবহন করা ট্রাক ও অন্যান্য গাড়িতে মালামাল ঢেকে রাখা; নির্মাণাধীন এলাকায় মাটি/বালু/সিমেন্ট/পাথর/নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা; সিটি করপোরেশন রাস্তায় পানি ছিটানো; রাস্তা/কালভার্ট/কার্পেটিং/খোঁড়াখুঁড়ির কাজে দরপত্রের শর্ত পালন নিশ্চিত করা; সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধ করা; পরিবেশগত সনদ ছাড়া চলমান টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা; মার্কেট/দোকানের প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা এবং বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করার বিষয়গুলো রয়েছে। সম্প্রতি (৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে উচ্চ আদালতের এই ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এ ব্যাপারে আদালত পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ভোরের কাগজকে বলেন, কার্যকরী কোনো অগ্রগতি নেই। আজকেও বায়ুদূষণের শীর্ষে ঢাকা। অগ্রগতি থাকলে এটি হতো না। না থাকার পেছনে অনেক কারণ আছে। আদালত তার রায় বাস্তবায়নের জন্য শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন না। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছিল ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, ওখানে ৯ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। পরের বছর আরো তিন দফা বাড়িয়ে ১২ দফা করা হয়। ওই নির্দেশনার এক দুটি ব্যতিরেকে বেশির ভাগই মানা হয়নি। আদালতকে ক্রমাগত অবমাননা করা হচ্ছে। দায়িত্বশীলরা বোধহয় এ ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App