×

জাতীয়

মুক্ত গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ ভাবনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

বিগত এক দশকেরও বেশি সময়জুড়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের যে বিস্তৃতি ঘটেছে তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। একদিকে গণমাধ্যমের যেমন বিকাশ ঘটেছে; তেমনি অন্যদিকে টেলিভিশন, অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তার লক্ষ্য করার মতো। দুটি প্রশ্ন সবার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে- কতখানি পেশাদারিত্বের সঙ্গে এই গণমাধ্যম নতুন চেহারা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণমাধ্যম কতখানি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পেরেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বনাশী প্রভাব মানুষকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করে দিয়েছে। একবিংশ শতাব্দিতে এসে বিশ্ব গণমাধ্যমকে যে এভাবে একটি নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে, সেটা হয়তো কয়েক দশক আগেও কল্পনা করা সম্ভব হয়নি। টেকনোলজির দ্রুত পরিবর্তন গণমাধ্যমকে এমন একটি অভাবনীয় পরিবর্তনশীল জায়গায় নিয়ে এসেছে- যেটা বিশ্বের খ্যাতনামা গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের কল্পনার বাইরে ছিল। মাত্র কয়েক দশকে বদলে গেছে গণমাধ্যমের আমূল চিত্র। বিষয়, উপস্থাপনা এবং বৈচিত্র্যের নতুন বাস্তবতায় গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা হতভম্ব। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন একটি বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে গণমাধ্যমের সামনে। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সুযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষের মনোজগতে এমন একটি জায়গা করে নিয়েছে, সেখানে প্রচলিত গণমাধ্যমকে প্রতিদিন একটি নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে অগ্রসর হতে হচ্ছে। এই অবস্থায় উন্নত দেশগুলোর গণমাধ্যম কিছুটা খাপ খাইয়ে নিলেও সংকটে পড়েছে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো। এসব দেশে টেকনোলজির বিস্তার ঘটলেও মিডিয়ার এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। যে কারণে বাড়ছে সংঘাত, নতুন বনাম পুরনো মিডিয়ার। অর্থাৎ নিউ মিডিয়া বনাম ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া।

এই দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ে প্রথাগত মিডিয়াকে যুক্ত হতে হচ্ছে অনলাইনে, অনলাইনকে যুক্ত হচ্ছে মাল্টিমিডিয়ার দিকে, অন্যদিকে মাল্টিমিডিয়া ও টেলিভিশন মিডিয়াকে যুক্ত হতে হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে এক ধরনের সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানবিহীন সাংবাদিকতা, তা গণমাধ্যমকে ফেলে দিচ্ছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ। যদিও যোগাযোগের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন গণমাধ্যমকে এনেছে একটি পরিবর্তনশীল ধারায়- যার সঙ্গে আসলে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক বিশ্বে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নানারকম পদক্ষেপ নেয়া হলেও যেসব দেশে মিডিয়া লিটারেসি কম সেখানে একটি সংকট তৈরি করেছে, রুদ্ধ করেছে গণমাধ্যমের নতুন বিকাশ। গণতন্ত্রের অনুষঙ্গ হিসেবে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এখন গণমাধ্যম নতুন চেহারা নিয়ে একটি নতুন বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে গণমাধ্যম কি ভূমিকা পালন করবে এবং কোন চেহারা নিয়ে- সেটা একটি বড় প্রশ্ন এখন।

অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার এই বিস্তার নতুন নতুন সংকট তৈরি করছে দেশে দেশে, সমাজে সমাজে। যেহেতু এই ধরনের গণমাধ্যমের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালা নেই- ফলে সমাজে সমাজে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, ধর্মে ধর্মে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি করছে নতুন নতুন সংকট। এমনকি খোদ মার্কিন নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রভাব তৈরি করছে, মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলছে- এমন অভিযোগের প্রমাণ আছে। অন্যদিকে অনুন্নত দেশগুলোতে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসেছে একটি ভয়াবহ চেহারা নিয়ে। একথা সত্যি, যে পরিবর্তন ঘটে গেছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া যেমন যাবে না, আবার এর সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে চলাও বড় কঠিন। যে কারণে একটি দোলাচল বা অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়েই এই মুহূর্ত পার করতে হচ্ছে গণমাধ্যমকে।

বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমও এই বাস্তবতার মুখোমুখি। শত শত পত্রিকা, হাজার হাজার অনলাইন, অসংখ্য টেলিভিশন কতখানি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করছে এই নতুন বাস্তবতায়, সেটি এখন একটি বড় প্রশ্ন; কিন্তু এই পুরো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পথ আমাদের জানা আছে- সেটা বলা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিদিনই তথ্যপ্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে গণমাধ্যমের চেহারাও। ফলে কোনো সুনির্দিষ্ট একটি গাইডলাইন কবে তৈরি করা সম্ভব, সেটিও বলা এখন খুবই মুশকিল।

গণমাধ্যমের এ রকম একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ৩১ বছরের পুরনো একটি গণমাধ্যম দৈনিক ভোরের কাগজ, যার জন্ম হয়েছিল স্বৈরাচারের পতনের পর। একটি কাক্সিক্ষত গণতন্ত্রের যাত্রার মুহূর্তে, যার প্রত্যাশা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ, যেখানে সব মত ও পথের একটি মিলনস্থল হবে সেটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ৩১ বছর পর যে আকাক্সক্ষা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু তার পরিস্থিতি আমূল পাল্টে গেছে। সমাজ উন্নত হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি পরিবর্তন করেছে গণমাধ্যম পরিস্থিতি। নতুন বাস্তবতায় এই অবস্থায় যে আদর্শ নিয়ে ৩১ বছর আগে যাত্রা শুরু, এখন তা কোন জায়গায় আছে- সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই মুহূর্তে প্রতিযোগিতার বাজারে যেখানে অসংখ্য পুঁজি গণমাধ্যমে চলে এসেছে ভিন্ন কারণে, সেখানে আদর্শ বা লক্ষ্য নিয়ে গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখা কঠিন বাস্তবতা তৈরি করে দিয়েছে। নতুন পুঁজির বিকাশ হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এবং সেই পুঁজি আক্রমণ করেছে গণমাধ্যমকেও। নিজেদের কালো অর্থকে সামলাবার জন্য তারা বিনিয়োগ করেছে গণমাধ্যমে। এই অসৎ ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় একটি গণমাধ্যম কীভাবে সততার সঙ্গে টিকে থাকবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রতিদিন নতুন নতুন কাগজ বেরোচ্ছে; কিন্তু কেন বেরোচ্ছে, কারা বের করছে, কি উদ্দেশ্যে বের করছে- এটি নিয়ে একটি গবেষণা হতে পারে। কিন্তু সবাই জানেন এর উদ্দেশ্যগুলো কি। এই ধরনের একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে একটি প্রকৃত সাংবাদিকতার পরিবেশ তৈরি করে গণমাধ্যমকে এগিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি সামাজিক দায়িত্ববোধ প্রধান কারণ না হয়- যদি শুধু আপনার ব্যবসাকে প্রতিরক্ষা দেয়ার জন্য গণমাধ্যম বের করা উদ্দেশ্য হয় থাকে, যদি কালো পুঁজিপতিরা গণমাধ্যমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য গণমাধ্যম বের করতে আসেন, সেই দেশে গণমাধ্যমের প্রকৃত বিকাশ হওয়া খুবই কঠিন। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশ এখন এ রকমই একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি।

গণমাধ্যমের যখন এই পরিস্থিতি, তখন ১৯৯২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করা একটি উদ্যোগ আজ নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। ভোরের কাগজ প্রকাশিত হয়েছিল গণতন্ত্রকে বিকাশের লক্ষ্য নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শানিত করার লক্ষ্য নিয়ে, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং গণতন্ত্রকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আজকে ৩০ বছর পর মূল্যায়ন করবেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞগণ; কিন্তু এটি সত্যিই বাস্তবতা যে, এ ধরনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে গণমাধ্যমে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি কঠিন অবস্থার মুখোমুখি গণতান্ত্রিক কাঠামো, বিভাজিত রাজনৈতিক সমাজ এবং সেই সমাজে দ্রুত পুঁজিপতিদের উত্থান এবং তাদের হাতে গণমাধ্যম চলে যাওয়ায় প্রকৃত সব গণমাধ্যম এখন প্রায় কোণঠাসা। এ রকম একটি অবস্থায় ভোরের কাগজের মতো গণমাধ্যমগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি ও কালো পুঁজিপতিদের থাবার সঙ্গে প্রতিদিন লড়াই করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিয়েই ৩১ বছর পেরিয়ে ৩২ বছরে পা দিচ্ছে ভোরের কাগজ।

লেখক : শ্যামল দত্ত, সম্পাদক ভোরের কাগজ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App