×

জাতীয়

গণমাধ্যমে সাংবাদিকতার প্রকৃতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপ্রাচীন গুরুদাস কলেজের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্দেশে ‘বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমে সাংবাদিকতার প্রকৃতি’ বিষয়ে কথা বলতে হয় আমাকে সম্প্রতি। বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অরুনিমা মূখার্জির আমন্ত্রণ খানিকটা কাকতালীয় হলেও শেষ পর্যন্ত উপলক্ষটি মন্দ কাটেনি। বিশেষ করে আলোচনাটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে যখন ছাত্রছাত্রীরা সমকালীন সাংবাদিকতার নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে যুক্ত হয়। ভালো লাগে এই ভেবে যে, সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরাও সমকালীন সাংবাদিকতার ভালোমন্দ নিয়ে ভাবে। বর্তমান নিবন্ধটি সেদিনের আলোচনারই একটি সংক্ষিপ্তসার।

আমার বিশ্বাস, সাংবাদিকতার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনার আগে প্রথমে গণমাধ্যম বিষয়টি খোলাসা হওয়া দরকার। কারণ বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম কেবল সাংবাদিকতা নয়, আরো বহুবিধ কাজ করে। তারা একদিকে যেমন জনজীবনের প্রাত্যহিক ঘটনাবলি ‘ইনফর্ম’ করে, একই সঙ্গে তারা মানুষকে ‘এজুকেট’ করে, এবং ‘এন্টারটেইমেন্ট’ করে, ‘অ্যাডভারটাইজ’ করে এবং ‘প্রোপাগান্ডা’ করে। শুধু এই নয়, কিছু কিছু গণমাধ্যম পরিকল্পিতভাবে ‘ফেক নিউজ’ বা তৈরি করা খবর প্রচার করে বলেও অভিযোগ কম নেই! এ রকম অভিযোগ পুরোটাই অস্বীকার করা যাবে বলে আমারও মনে হয় না।

সবাই স্বীকার করবেন যে, বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যমের প্রভাব বেড়েছে। ব্যাপকতার এই স্বরূপ সম্প্রতিকালে বহুগুণ সম্প্রসারিত হয়েছে, সব দেশে, সব অঞ্চলে। একমাত্র কমিউনিস্ট ও রাজতন্ত্রীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া সারাবিশ্বেই এই সম্প্রসারণ ঘটেছে। বলতেই হবে যে, ব্যাপক এই সম্প্রসারণ নিঃসন্দেহে মুক্ত সাংবাদিকতার পথে ইতিবাচক পদক্ষেপ, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর বিস্তারে যা সম্ভব হয়েছে।

তবে আগেকার এবং বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতার মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ করার আছে। আগে যেখানে প্রিন্ট মিডিয়াই ছিল সাংবাদিকতার মূল বাহন, আজ সেখানে ইন্টারনেট এসে তার পরিধি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এসেছে স্যাটেলাইট টেলিভিশন। বিশ শতকে, এমনকি গত শতকের শেষার্ধেও আমাদের উপমহাদেশীয় দেশগুলোতে টেলিভিশন সাংবাদিকতার তেমন প্রসার ঘটেনি। সে সময়ে সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যম ছিল নিতান্তই প্রিন্ট বা ছাপাখানানির্ভর। আমরা যদি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা ভাবি, তখন ভারত ও পাকিস্তানের সাংবাদিকতা ছিল আক্ষরিক অর্থেই প্রিন্টনির্ভর। টেলিভিশন যদিও চালু হয়েছিল কিন্তু মোটেও বিস্তার লাভ করেনি।

স্মরণ করা যেতে পারে, দিল্লিতে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে টিভি সম্প্রচার শুরু করা হয় ১৯৫৯ সালে। ভারতে টিভির দৈনিক সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায় প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর। সে সম্প্রচার ছিল খুবই সীমিত আকারে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথম স্যাটেলাইট টেলিভিশন হিসেবে এটিএন বাংলার যাত্রা শুরু হয়। তবে বেসরকারি খাতে টেরিসট্রিয়াল টিভি হিসেবে প্রথম সম্প্রচার শুরু করে ২০০০ সালে একুশে টেলিভিশন। বলা বাহুল্য, একুশে টিভি বাংলাদেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এরপর দ্রুত স্যাটেলাইট টেলিভিশনের বিকাশ ঘটে দেশে এবং গণমাধ্যমের পরিধি বিস্তারে নতুন যুগের সূচনা করে।

১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন দেশের মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণ করার সুযোগ ঘটে। যুদ্ধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি যুদ্ধকালীন সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত থাকতে হয় আমাকে একাত্তরের জাতীয় রণাঙ্গনে। সে কারণে তখনকার সাংবাদিকতার, বিশেষ করে ভারতীয় এবং বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বিষয়াদি কমবেশি জানবার সুযোগ ঘটে। বাস্তবতার স্বার্থেই স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল অনন্য সাধারণ, যা আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ অংশ।

আমরা সবাই জানি, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর প্রসারে সাংবাদিকতার পরিধি আজ ব্যাপক ও বিস্ময়করভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে অনেকে এও বলে থাকেন, এই সম্প্রসারণ ঘটেছে কেবলই বহিরাঙ্গে, অন্তরে বা আত্মায় নয়। হয়তো সে কারণে সাংবাদিকতার ‘কমিটমেন্ট’ নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে। মানতেই হবে স্পিড, কালার, কনটেন্ট ইত্যাদির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে গণমাধ্যমের। টিভির অনুষ্ঠান ‘লাইভ’ বা সরাসরি হচ্ছে। মোবাইল ফোন কিংবা আইপ্যাডের স্ক্রিনে সবকিছুই এখন হাতের নাগালে। বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে সব দেশের সংবাদপত্র এখন নিমিষে পাঠ করা যায়। সব ভাষার, সব চরিত্রের, সব সংবাদপত্র এখন আন্তর্জাতিক; গণমাধ্যম আজ কেবল দেশীয় বা আঞ্চলিক নয়, থাকারও সুযোগ নেই। সে কারণে অনেকে ভয় পান ‘অনলাইনের’ এই যুগে প্রিন্ট বা ছাপা কাগজের সংবাদপত্র কোথায় নাকি হারিয়ে যায়! হারিয়েছেও কিছু কিছু। কিন্তু প্রিন্টের যে স্বাদগন্ধ আছে তাকে অস্বীকার করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। আমার বিশ্বাস, প্রিন্ট থাকবে এবং নিজের মর্যাদাতেই থাকবে; যেমনি ইলেকট্রনিক পুস্তকের ব্যাপক প্রসারের পরেও বই ছুঁয়ে দেখার আনন্দ কমেনি আজো।

তবে বলতেই হবে, অধুনা সাংবাদিকতার বেশকিছু সংকট বা সীমাবদ্ধতা আছে, যা হরহামেশাই লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন, সাংবাদিকতা যতটা শরীরের রূপে বেড়েছে ততটা অন্তরে বা ‘কমিটমেন্টে’ বাড়েনি। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ‘অ্যাডভারটাইজমেন্ট’ এবং ‘প্রোপাগান্ডা’ হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যই মুখ্য হয়েছে। এসব অভিযোগ যদি আমলে নেই, না নেয়ারও সঙ্গত কারণও নেই, তাহলে বর্তমান সাংবাদিকতার কতিপয় বড় প্রতিবন্ধক নিশ্চয়ই চিহ্নিত করা উচিত হবে।

এখন দেখবার চেষ্টা করি কী কী প্রতিপক্ষ বা প্রতিবন্ধকতা আছে অধুনা সাংবাদিকতার। কারণ এই চিহ্নিতকরণ যদি করা যায় এবং সে লক্ষ্যে কাজ করা যায়, তাহলে সাংবাদিকতা গৌরবান্বিত হবে।

আমার বিশ্বাস, আগেকার দিনের মতো মুক্ত বা স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতিপক্ষ এখন কেবল স্বৈরাচারী সরকার বা রাষ্ট্রশক্তি নয়। পরিবেশ বা পরিস্থিতি বদলেছে। বিশ্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রভূত বদলেছে। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নানাবিধ চতুর আইনের প্রতিবন্ধকতা আছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার সহায়ক নয়। এর বাইরেও আরো বহুবিধ প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়েছে। যেমন ক. বড় পুঁজির আধিপত্য, খ. বাণিজ্যকরণের আধিপত্য, গ. অসহিষ্ণু দল ও স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীর আধিপত্য, ঘ. ধর্মীয় উগ্রবাদের আধিপত্য, ঙ. সংবাদকর্মীদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক প্রভাব, চ. জনস্বার্থ বিবেচনা বা ‘কমিটমেন্টের’ ঘাটতি ইত্যাদি। এর পরেও আরো কিছু প্রতিবন্ধক নিশ্চয়ই আছে, যা সাংবাদিকতার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। যেমন অনেক ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন, সংবাদকর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি।

এর পরেও বলতে হবে যে, বর্তমান যুগে সাংবাদিকতার প্রভাব ও প্রসার বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে সংকটও। সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পেশা, এ পেশা মহত্ত্বের দাবিদার। তবে জানা এবং মানা দুটিই প্রয়োজন যে, এই পেশা সংবাদকর্মীদের জন্যে কেবলই চাকরি নয়, কিংবা সংবাদশিল্পের মালিকদের জন্য কেবলই ব্যবসা নয়। অনেক ক্ষেত্রে এর অন্যথা ঘটে বলে সাংবাদিকতা মর্যাদা হারায়।

আমার বিশ্বাস, সাংবাদিকতার মান আরো বাড়বে, যদি চিহ্নিত সংকটগুলো দূর করার চেষ্টা করা হয়। এসব সংকট বা প্রতিপক্ষ, যা এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে উল্লেখিত হলো, তা এক এক দেশ ও সমাজে একেক রকম হতে বাধ্য। আমি কেবল নিজের উপলব্ধিতে কথাগুলো উপস্থাপন করলাম।

হারুন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। email: [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App