×

সারাদেশ

কুড়িগ্রামের অন্ধ মেহেদি ব্যারিষ্টার হতে চায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৬:২১ পিএম

কুড়িগ্রামের অন্ধ মেহেদি ব্যারিষ্টার হতে চায়

ছবি: ভোরের কাগজ

অন্ধত্ব যাকে হার মানাতে পারেনি সেই অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থী মেহেদি হাসানের ইচ্ছা ব্যারিস্টার হওয়ার। চোখে দেখতে না পারলেও এসএসসিতে সে ঢাকা বোর্ড থেকে নবম স্থান অর্জন করেছে। বর্তমানে ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগে পড়াশোনা করছেন মেহেদি হাসান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে পড়ালেখা শেষ করে ভবিষ্যতে সে ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

কিন্তু তার সে স্বপ্ন পূরণের যাত্রায় হাজারো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বর্তমানে মেহেদী হোষ্টেলে থেকে খাবারের টাকা আর টিউশনির টাকা সংগ্রহ করায় দুরুহ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় অদম্য মেধাবী মেহেদীর চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে।

কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের কাজিপাড়ার ট্রাক চালক আক্কাছ আলী-মল্লিকা বেগম দম্পত্যির ঘরে জন্মনেয় মেহেদি হাসান। ভাই-বোনের মধ্যে সব ছোট মেহেদি হাসান। আছমা আকতার নামে এক বোন জন্ম থেকে বহু মাত্রিক প্রতিবন্ধি। তার বাবা বয়সের ভারে এখন আর ট্রাক চালাতে পারেন না। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বেকার হয়ে পড়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে পরিবারটির।

যে দৃষ্টিহীন মেধাবী মেহেদী হাসানের ব্যারিস্টার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা অথচ সেই মেহেদী হাসানের আজ অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ হবার উপক্রম। মাত্র ৬ শতক জমির উপর বসতবাড়ি তৈরি করে আছে মেহেদী হাসানের পরিবার।

মেহেদী হাসানের মা জানায়, ৭/৮ বছর বয়সে মেহেদীর চোখে সমস্যা দেখা দেখা দিলে তাকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা উলিপুরে মরিয়ম চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে দেখে সিরাজগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে রেফার্ড করে। এরপর চিকিৎসার জন্য ওই হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা অপারেশন করেন। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মেহেদির বাম চোখে ইনফেকশন হয়।

সঠিক চিকিৎসার অভাবে হত দরিদ্র পরিবারের মেধাবী মেহেদী হাসানের দু’চোখে ধীরে ধীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ায় ২০১২ সালের সে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ঢাকা চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসকরা মেহেদির পরিবারকে ভারতের চেন্নাইতে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে প্রায় ২৫ লাখ টাকা খরচ করে উন্নত চিকিৎসা করা গেলে মেহেদি আবারও দেখতে পাবে বলে আশার বাণী শুনিয়েছেন ওই চিকিৎসকরা।

মেহেদি হাসান জানায়, ছোট বেলা থেকে পড়াশুনার প্রতি প্রবল ঝোক তার। ২০২১ সালে সে ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার জানে আলম সরকার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করে। সে এসএসসিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ ঢাকা বোর্ডে ৯ম স্থান লাভ করে। বর্তমানে সে ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করছেন। থাকে আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ৩২১নং কক্ষে। চলতি বছর কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। ভালো ফলাফল করে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ার স্বপ্ন তার।

এর আগে মিরপুর দৃষ্টি প্রতিবন্ধি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৪.৫৮ এবং জেএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিল মেহেদী। দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হয়েও ঢাকায় চলা ফেরা করেন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতোই। অর্থাভাবে আর পুরাতন অডিও বইয়ের কারণে সামনে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবার ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় কাটছে মেহেদির দিন-রাত। পরীক্ষার সময় সূচি ঘোষণা হলেও হাতে আসেনি নতুন বই। শ্রেণী কক্ষেও পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। শিক্ষকরা পাঠদানের সময় ব্লাক বোর্ডে লিখে দিলেও সেগুলো আর নিজ খাতায় তোলা হয় না শ্রুতি লেখকের অভাবে। ফলে আগামী এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে সে। সরকারি এবং দাতা সংস্থার মাধ্যমে যে বই গুলো ভিউ ফাউন্ডেশন এবং ইফশা সংগঠনের মাধ্যমে দেয়া হয় সেগুলোও পুরাতন। যদিও নতুন বই দেবার নিয়ম কিন্তু সংগঠন দু’টি সেগুলো মানছে না। সে শিক্ষা ভাতার জন্য আবেদন করেছেন আজিমপুর সমাজসেবা অফিসে। এছাড়াও পরীক্ষার সময় শ্রুতি লেখকের সম্মানিভাতা নিজেদের পকেট থেকে দিতে হয়। মেহেদির মোবাইল নং ০১৫২১৭০৫৬৪০।

মেহেদির বাবা আক্কাছ আলী বলেন, বাড়ি ভিটে টুকু ছাড়া আমার আর কোন সম্পদ নেই। ছেলে পড়াশোনা করছে ঢাকাতে। দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি বাজারে মেয়ের প্রতিবন্ধি ভাতা দিয়ে কোন মতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। চিকিৎসকরা বলেছেন মেহেদিকে ভালো করা যাবে চেন্নাইতে নিয়ে গেলে। এজন্য প্রায় ২২/২৫ লাখ টাকা খরচ হবে।

মা মল্লিকা বেগম জানান, সংসারে দুটি প্রতিবন্ধি সন্তান আছে। এরমধ্যে মেহেদি ভালোই ছিল ৭/৮ বছর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু একটি চোখে সমস্যা হবার পর ভুল চিকিৎসায় ছেলেটার দুই চোখ অন্ধ। চিকিৎসক বলছে মেহেদিকে ভালো করা যাবে টাকা-পয়সা খরচ করলে। সরকার বা সমাজের বিত্তবানরা যদি কেউ একটু এগিয়ে আসে তাহলে আল্লাহ চাইলে মেহেদি আবারও পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে।

ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান জানান মেধাবী মেহেদীর অবস্থা খুব খারাপ। সরকার ও সমাজের বিত্তবানরা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে তার চোখের চিকিৎসা সম্ভব।

ঢাকা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাসরিন আক্তার বলেন, মেহেদি হাসান জন্মান্ধ নয়। সে চিকিৎসা জনিত কারণে অল্প বয়সে তাকে অন্ধত্ব বরণ করতে হয়েছে। সে মেধাবী শিক্ষার্থী হলেও শ্রুতি লেখক এবং বই সংকটের কারণে ভবিষ্যৎ ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন তার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App