×

জাতীয়

নতুন আতঙ্ক ‘শয়তানের শ্বাস’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:১৯ এএম

নতুন আতঙ্ক ‘শয়তানের শ্বাস’

ফাইল ছবি

ব্যবহার করছে ছিনতাইকারী মলমপার্টি অপহরণচক্র ভিকটিমের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অপরাধীর হাতে

নিজের আইফোন বিক্রির জন্য বিক্রয় ডটকমে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন রেজুয়ান আহমেদ তুষার নামে এক ব্যক্তি। বিজ্ঞাপন দেখে এক ক্রেতা তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ফোন নিতে আসেন। আইফোনের সঙ্গে স্ত্রীকে গোল্ড উপহার দেবেন জানিয়ে ওই ব্যক্তি রেজুয়ান আহমেদকে একটি স্কচটেপ দিয়ে সেগুলো প্যাকেট করে দিতে বলেন। ওই ব্যক্তির কথামতো স্কচটেপ মোড়ানোর পর রেজুয়ানের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ওই ক্রেতার কাছে। ক্রেতার কথামতো টাকা না নিয়ে ফোন দিয়ে দেন। ১০ মিনিট পর মাথা কাজ করা শুরু করে তার। ততক্ষণে ওই ব্যক্তি চম্পট দেয়। রেজুয়ান আহমেদের ধারণা স্কচটেপে ‘স্কোপোলামিন’ বা ‘শয়তানের শ্বাস’ নামক ভয়ঙ্কর মাদক ব্যবহার করে আইফোন হাতিয়ে নেয়া হয়েছিল।

গত ২৬ সেপ্টেম্বরের এ ঘটনায় রাজধানীর পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। শুধু এ ঘটনা নয়, ‘স্কোপোলামিন’ বা ‘শয়তানের শ্বাস’ নামক মাদক সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটছে অহরহ ঘটনাও। বিশেষ করে ছিনতাইকারী ও মলমপার্টির সদস্যরা সর্বস্ব লুটে নিতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এটি। এমনকি অপহরণকারীরাও এই মাদকের দিকে ঝুঁকছে। কৌশল হিসেবে পথচারীদের কাছে গিয়ে চিরকুটে লেখা ঠিকানা জানতে চাচ্ছে, প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে বলা হচ্ছে- কোন ফার্মেসিতে গেলে ভালো হবে, অনুদান বা ভিক্ষা চেয়ে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করা হচ্ছে, ছোট কোনো সহযোগিতা চেয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে হ্যান্ডশেক করা হচ্ছে। আর এতেই ওই পথচারী মাদকের সংস্পর্শে এসে পুরোপুরি অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছেন। পরে ওই অপরাধীদের কথামতো নিজের ফোন, মানিব্যাগ ও স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে দিচ্ছেন। যখন মাদকটির প্রভাবমুক্ত হয়ে ভুক্তভোগী স্বাভাবিক হচ্ছেন, ততক্ষণে আর খোঁজ মেলে না ওই সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যদের। যারা ভিকটিম হচ্ছেন তারা লজ্জায় এসব ঘটনা কারো সঙ্গে শেয়ার করছেন না। নিচ্ছেন না আইনগত ব্যবস্থাও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘শয়তানের শ্বাস’ নামক মাদকটি মূলত লিকুইড ও শুকনো ধরনের হয়। এটি হেলুসিনেটিক মাদক। এটিকে বুরুন্ডাঙ্গা, কলম্বিয়ান ডেভিলস ব্রেথ, রোবট ড্রাগ, জম্বি ড্রাগ প্রভৃতি নামেও

ডাকা হয়। এই ড্রাগ ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। যার প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ২০ থেকে ৬০ মিনিট। আবার এই মাদক খাবারের সঙ্গে খাওয়ালে বা ইনজেকশনের মাধ্যমে পুশ করলে যার প্রতিক্রিয়া থাকে দু-তিনদিন। ত্বকে লাগিয়ে রাখলেও রক্তে মিশে কাজ করা শুরু করে এটি। এ মাদক গ্রহণে ভুক্তভোগীরা সম্পূর্ণভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগটি লুফে নেয় প্রতারকরা। এটিকে খালি চোখে দেখতে কোকেন পাউডারের মতো মনে হলেও এ থেকে ক্ষতির মাত্রা কোকেন পাউডারের থেকে কয়েকগুণ বেশি। এর ভয়াবহতা বোঝাতে গবেষকরা জানিয়েছেন, মাত্র ১ গ্রাম স্কোপোলামিন দিয়ে ১৫ জন মানুষকে হত্যা করা সম্ভব।

জানা গেছে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বিশেষ করে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি প্রভৃতি দেশে এটি মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। অপরাধীরা বিভিন্ন বয়সিদের যৌন মিলনে বাধ্য করতে এ মাদকটি ব্যবহার করে, পর্নোগ্রাফিক ভিডিও রেকর্ড করতে বা তাদের নগ্ন ছবি তোলার জন্যও এটি ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো এটির ফলে যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে এই মাদকের চালান ধরতে বিশেষ নজরদারি অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে, সম্প্রতি রাজধানীসহ সারাদেশে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় ‘শয়তানের শ্বাস’ নামক মাদকের ব্যবহার হওয়ায় এটি নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সবশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রলীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক অসিত পালের বিরুদ্ধে ওয়ালিউল্লাহ নামে এক ব্যক্তিকে ভয়ংকর এই মাদক ব্যবহার করে তুলে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। পরে ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবিসহ ৪৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। গত বুধবার সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলে এ ঘটনা ঘটে। গত বছরের জুনে রাজধানীর ধোলাইপাড় এলাকায় ডলি ইসলাম নামে এক নারীকে চোখে চোখ রাখতে বলে দুই প্রতারক তার কাছ থেকে স্বর্ণের চেইন, কানের দুল, একটি মোবাইল ও নগদ চার হাজার টাকা নিয়ে নেয়। এগুলো হাতিয়ে নেয়ার আগে এতিমখানায় সহায়তা করতে বলে তার মাথায় হাত রেখেছিলেন এক নারী।

ভুক্তভোগী নারী আরো জানান, সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হয় বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। বাসায় গিয়ে কয়েক ঘণ্টা পর আমার মনে হয় কাছে থাকা সব জিনিসপত্র অচেনা নারীকে দিয়ে এসেছি। ঘটনার দিন রাতেই আমার ছেলে কোতোয়ালি থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি করে। তখন থানা থেকে জানানো হয়, এমন ঘটনা এই এলাকায় আরো দুজনের সঙ্গে ঘটেছে। ঘটনার পর স্বাভাবিক হতে তার সময় লাগে প্রায় চারদিন। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী জোবায়ের আহমেদও পড়েন এমন প্রতারকদের খপ্পরে। গত বছরের জানুয়ারিতে তাজমহল রোড থেকে ৩০-৩৫ বছর বয়সি একজন পুরুষ তার হাতে একটি চিরকুট দেখিয়ে ঠিকানা জানতে চান। ঠিকানা বলার কয়েক মিনিট পর তার কাছে থাকা দুটি মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগে থাকা নগদ ৪০ হাজার টাকা নিজের অজান্তেই ওই ব্যক্তির কাছে দিয়ে দেন। বাসায় এসে তিন-চার ঘণ্টা পর ঘটনার কথা মনে পড়লে নিজেই নিজেকে দোষারোপ করতে থাকেন জোবায়ের। রাজধানীর মিরপুর এলাকার সানিয়া আক্তার মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় পরিচিত কণ্ঠে পেছন থেকে এক নারী তাকে ডাক দিলেন।

পেছনে ফিরতে হঠাৎ এক ব্যক্তি তার মুখের সামনে একটি কাপড়ের রুমাল ওড়ালেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন নারী তাকে একটি চিরকুট হাতে দেয়। এতে তিনি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেন। চক্রের সদস্যদের কথামতো সানিয়া স্বর্ণের হাতের বালা, গলার চেইন, কানের দুল ও মোবাইল দিয়ে দেন।

ফরিদপুর শহরের ষাটোর্ধ্ব আলেয়া বেগম তার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য স্বামীকে নিয়ে ব্যাংক থেকে পেনশনের টাকা তুলে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ি ফেরার পথে অটোরিকশায় উঠার কিছুক্ষণের মধ্যে চালকের আরেক সহযোগী উঠে ওই অটোরিকশায়। এরপর কৌশলে তাদের কাছে থাকা কাগজে মোড়ানো নেশাদ্রব্য নাকের কাছে নিয়ে শুকিয়ে তাকে স্মৃতিভ্রম করেন। এরপর তাদের কথামতো তিনি নিজেই প্রতারকদের হাতে খুলে দেন তার গলায় থাকা স্বর্ণের চেন, কানের দুল, হাতের আংটি। ফরিদপুরে সম্প্রতি এরকম আরো বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ১১ অক্টোবর বিকালে রাজবাড়ী শহরের এক নম্বর রেলগেট এলাকায় এ চক্রের খপ্পরে পড়ে দামি ফোন, সোনার আংটি, চেইন ও নগদ টাকা খোয়ান রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী প্রিয়া আক্তার (২৫)।

এ ঘটনায় ১৫ অক্টোবর প্রিয়ার মা ছালমা বেগম (৪৫) বাদী হয়ে রাজবাড়ী সদর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। গত ৪ অক্টোবর একই কায়দায় রাজবাড়ী সদর উপজেলার বসন্তপুর স্টেশন বাজার থেকে গৃহিণী রোকেয়া বেগমের স্বর্ণালঙ্কার লুটে নেয় দুই যুবক। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহরের চাঁদনীবাজার এলাকায় সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের কবলে পড়েন মাহবুবা সুরাইয়া নামে এক নারী। চক্রের সদস্যরা তাকে সম্মোহিত করে তার কাছ থেকে স্বর্ণের গহনা হাতিয়ে নেয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ঢাকা মেট্রো. উত্তরের উপপরিচালক (ডিডি) মো. রাশেদুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, এ ধরনের একটি মাদককে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে শুনেছি। আমরা এখনো এর অস্তিত্ব পাইনি। তবে আমাদের সর্বোচ্চ নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। যখন এ মাদক উদ্ধার হবে তখন ল্যাবে পাঠিয়ে পরীক্ষার পর বিস্তারিত বলা সম্ভব হবে। যেহেতু আমরা অস্তিÍত্ব পাইনি, তাই ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কতটা সত্য সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।

স্কোপোলামিন মাদকের বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, স্কোপোলামিন ড্রাগ ব্যবহার করে যারা প্রতারণা করছে তাদের কেউ এখনো শনাক্ত হয়নি। এ ড্রাগের ফলে অনেক ভুক্তভোগী দামি জিনিসপত্র খুইয়েছেন বলে মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি। এই মাদক থেকে নিজেদের সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। তাই রাস্তাঘাটে অপরিচিতদের থেকে সবসময় সতর্ক থাকুন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App