×

মুক্তচিন্তা

গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:১২ এএম

গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন

গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্কের অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ২০০২ সালে ‘দ্য ইন্টারঅ্যাকশন বিটুইন ডেমোক্র্যাসি এন্ড ডেভেলপমেন্ট’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব এবং ২০০২ সালে গণতন্ত্র ও উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের চেয়ারপারসন বুট্রোস বুট্রোস ঘালি কর্তৃক সম্পাদিত এই গ্রন্থের মুখবন্ধে ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাসচিব কোইচিরো মাৎসুরা বলেছেন, উন্নয়ন শুধু অর্থনীতির কোনো বিষয় নয় এবং এমনকি ‘পুরনো গণতন্ত্রগুলোতে’ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকারিতা জীবনযাপনের শর্তগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই উপলব্ধির কারণে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) চর্চার জন্য গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্কের প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং উন্নয়নের ধারবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা দুটি সহগামী শব্দবন্ধে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে একটি। বাংলাদেশের জনসংখ্যাগত লাভ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট), শক্তিশালী তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানি এবং স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থার দ্বারা সমর্থিত। কিন্তু সবচেয়ে যেটি অপরিহার্য তা হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা। যা দেশটির উন্নয়নকে টেকসই আকারে এগিয়ে নিচ্ছে। এসবই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার ফসল। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার কারণেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের দিকে অবিস্মরণীয় সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা মেট্রোরেল এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রভৃতি মেগা প্রকল্প বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সক্ষমতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে। এছাড়া খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বিদেশে খাদ্য রপ্তানি, সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে সফলতা অর্জন, করোনা বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অগ্রগতি অব্যাহত থাকা বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলা যেতে পারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট পর্যন্ত মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থাকাকালে গণতন্ত্র ও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠন তথা উন্নয়নের জন্য বিস্ময়করভাবে গুরুত্বপূর্ণ সফলতা অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও উন্নয়ন তথা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই সংগ্রাম করে নির্বাচিত হয়ে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের অভূতপূর্ব সফলতা বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’-এ পরিণত করেছে। এর সম্পূর্ণ বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী অগণতান্ত্রিক পন্থায় বল প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী পরপর দুজন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ এবং নব্বইয়ের পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের বেসামরিক সরকারের সাম্প্রদায়িকতা ও পশ্চাৎপদতার শাসনামলগুলো ছিল অগণতান্ত্রিক এবং ‘উন্নয়ন হারানো’র শাসনামল। দীর্ঘকাল ধরে বিশ্লেষকরা গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন দুটি আলাদা ধারণা হিসাবে গণ্য করতেন। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ উভয়ের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। একই সময়ে অনেক উন্নয়নশীল দেশ কর্তৃত্ববাদী শাসন দ্বারা শাসিত হওয়া সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির হার অর্জন করেছে। ১৯৭০-এর দশক থেকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা শুরু হয়েছিল, বিশেষত যখন লোকরা সচেতনতার সঙ্গে চিন্তা করছিলেন যে তারা যা চিন্তা করতেন গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সম্পর্ক তার চেয়ে আরো জটিল ঘটনা। তখন থেকে বিশেষত এটি উপলব্ধি করা হয়েছিল যে উন্নয়নের ধারণাকে শুধু তার অর্থনৈতিক ও আর্থিক মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না, যেখানে এটি এতদিন সীমাবদ্ধ ছিল এবং এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত মাত্রাগুলোও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৮০-এর দশকের ক্রাইসিস, বিশ্বের অনেক অঞ্চলে ‘উন্নয়নের হারানো দশক’, এই ইস্যুতে নতুন করে প্রশ্ন তোলার প্ররোচনা দেয়, যা আরো জরুরি বলে মনে হয়েছিল। কারণ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের সমস্যার সমাধান নিয়ে আসতে স্পষ্টতই অক্ষম ছিল। বিশ্বের দ্বিমেরুকরণের অবসান, কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র ব্যবস্থার পতন, অধিকাংশ কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন এবং সুশীল সমাজ দ্বারা উদ্ভূত নতুন সংগঠনের উত্থানের ফলে গণতন্ত্র/উন্নয়ন দ্বা›িদ্বক শেষ পর্যন্ত সমসাময়িক বিতর্কের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গণতন্ত্রকে সংহতকরণ এবং দেশ পুনর্গঠনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। ‘ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এবং ২৫ মার্চের শেষ প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা, একই বছরের এপ্রিলে সরকার গঠন, ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন এবং প্রথম কন্সিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির মাধ্যমে এই প্রচেষ্টার সূচনা হয়। প্রণীত এই সংবিধান অনুসারে ১৯৭৩ সালে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এ নির্বাচিত সরকার প্রধানকে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হত্যার মাধ্যমে এই উদ্যোগগুলো ভেঙে দেয়া হয়েছিল এবং হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত সরকার প্রধান জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত গণতন্ত্রকেই হত্যা করেছিল খুনি খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমানের অনুসারীরা। এভাবে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন তথা উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষ এবং দ্বিতীয় দশকের শুরু থেকে বিশেষত ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘উন্নয়ন অভিমুখে’ বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। এর বিপরীতে বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর আশির দশক বাংলাদেশের জন্য ছিল ‘উন্নয়নের হারানো দশক’ (ডেভেলপমেন্ট’স লস্ট ডিকেড)। ‘দ্য ইন্টারঅ্যাকশন বিটুইন ডেমোক্র্যাসি এন্ড ডেভেলপমেন্ট’ গ্রন্থের ভূমিকায় জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব মিসরীয় কূটনীতিক বুট্রোস বুট্রোস ঘালি (২০০২) আশির দশককে এভাবেই আখ্যায়িত করেছেন। একুশ শতককে এশীয় শতাব্দীতে পরিণত করার ক্ষেত্রে যেমন বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হওয়া ছোট রাষ্ট্র বাংলাদেশের অবদান একটি অনস্বীকার্য বিষয়। তেমনি বিশ্ব পরিমণ্ডলে বিংশ শতাব্দীর আশির দশককে ‘উন্নয়নের হারানো দশক’ হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশেরও কিছু অবদান রয়েছে। আর এই অবদান এসেছে সামরিক স্বৈরাচারদ্বয়ের হাত ধরে। এই সময়ব্যাপী সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল এইচ এম এরশাদ বাংলাদেশকে স্বৈরাচারী কায়দায় শাসন করেছেন। দক্ষিণ এশিয়া আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। মূলত এই অঞ্চলের চারটি দেশ এই অগ্রযাত্রার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এই দেশগুলো হচ্ছে- ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর থেকে শ্রীলঙ্কা এখন সবচেয়ে খারাপ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। পাকিস্তানে ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তার দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাইরের দেশগুলোর সাহায্য কামনা করেছেন। পাকিস্তানের সংকটের প্রকটতার মাত্র কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি। সম্প্রতি একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর পেশোয়ারের একটি মসজিদে নামাজিদের মধ্যে অবস্থান নেয় এবং প্রায় ২২ পাউন্ড বিস্ফোরক বিস্ফোরণ ঘটায়। মসজিদের প্রাচীর ভেঙে যায় এবং ১০০ জনেরও বেশি লোক এই জঘন্য হামলায় প্রাণ হারান। অনেকেই এখন বলছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান তাদের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মিরাকল বা অলৌকিক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। শ্রীলঙ্কাভিত্তিক ডেইলি নিউজে প্রকাশিত জন রোজারিওর লেখা একটি ফিচার স্টোরির শিরোনাম হচ্ছে- শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান : ‘বাংলাদেশ মডেল থেকে শিক্ষা’। স্বাধীনতার একান্ন বছরে পদার্পণ করার সময়ে বাংলাদেশ অসাধারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। যা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সংযোগের একটি উদীয়মান কেন্দ্রে পরিণত করেছে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ আকর্ষণ করছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। এসবই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ধারাবহিকতার ফসল। এ কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অপরিহার্য। তবেই কেবল গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার সঙ্গে উন্নয়নের ধারাবাহিকতাও অব্যাহত থাকবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের সচেতন দেশপ্রেমিক জনগণ বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা মনেপ্রাণে আশা করে।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App