×

আন্তর্জাতিক

সময়ের সঙ্গে ফুরাচ্ছে উদ্ধারের আকুতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:১০ পিএম

সময়ের সঙ্গে ফুরাচ্ছে উদ্ধারের আকুতি

ছবি: সংগৃহীত

সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভবনের ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের জীবিত উদ্ধারের আশা ততই ক্ষীণ হচ্ছে। অনেককে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও এখনও হাজার হাজার মানুষ ভবনের নিচে আটকা পড়ে আছেন। প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে উদ্ধারকর্মীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা কমছে। সেই সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যু।

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজন দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই এখন খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন। যাঁদের স্বজন এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছেন, তাঁদের অসহায়ত্ব আরও বেশি। কেউ কেউ বলছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে স্বজনদের উদ্ধারের আকুতি তাঁরা শুনেছেন। তবে তাঁরা কিছু করতে পারেননি। কিন্তু এখন আর তাঁরা কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছেন না।

তুরস্কের কাহরামানমারাস,ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেখানে ধ্বংসস্তূপ থেকে ৪০ ঘণ্টা পর একটি মেয়েশিশুকে মঙ্গলবার রাতে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ব্যথায় কাতর ১৪ বছরের শিশুটি প্রথমেই যে কথাটি বলেছে, তা হলো- 'দয়া করে আমার বাবাকেও বাঁচান।' তার বাবা কাছাকাছি জায়গাতেই আছেন বলে জানায় সে। পরে রাতেই বাবাসহ তার পরিবারের দুই সদস্যকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু তারা ছিলেন প্রাণহীন।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্কে জোর উদ্ধার তৎপরতা চলছে। তবে ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতার কারণে উদ্ধার কঠিন হয়ে পড়েছে। তুর্কি সাংবাদিক ইব্রাহিম হাসকোলোলু দুর্গত এলাকা থেকে বিবিসিকে জানান, বহু মানুষ এখনও (ধসে পড়া) ভবনের নিচে রয়েছেন। তাঁদের সাহায্যের প্রয়োজন। তিনি বলেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে আটকে পড়া লোকজন তাঁকে এবং অন্য সাংবাদিকদের ভিডিও, ভয়েস নোট এবং তাঁদের লাইভ অবস্থান পাঠাচ্ছেন। তিনি বলেন, তারা আমাদের বলছে যে তারা কোথায় আছে। কিন্তু তাদের জন্য কিছুই করা যাচ্ছে না। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের নুমুনে জেলার বাসিন্দা আরজু দেদিওগলু বলেন, তাঁর দুই ভাতিজি আয়শাগুল ও ইলাইদা ভবনের ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছে। কিন্তু তাদের উদ্ধারে তৎপরতা নেই। তিনি বলেন, তিনি নিশ্চিত তারা আর বেঁচে নেই।

তুরস্কের গাজিয়ানতেপের বাসিন্দা মেলেক হালিসি। বুধবার গভীর রাতে তিনি তাঁর দুই বছর বয়সী মেয়েকে কম্বলে মুড়িয়ে উদ্ধারকাজ দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ধ্বংসস্তূপের ওপরে বসতেও তাঁদের ভয় হয়। মনে হয়, হয়তো কেউ এই ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছেন।

সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত জিন্দারিসের বাসিন্দা হাসান। তিনি বলেন, যে ভবনগুলো ধসে পড়েনি, সেগুলোও ভূমিকম্পে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেক মানুষ রয়েছেন।

তুরস্কের হাতায় ৫২ ঘণ্টা পর ওয়াইজিত চাকমাক নামের আট বছরের এক শিশুকে উদ্ধার করা হয়। ওয়াইজিত ধ্বংসস্তূপের ভেতরে কান্না করছিল। বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন তার মা। উদ্ধারের পর এক আবেগঘন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আবেগাপ্লুত মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই হাতায়ই ৫৬ ঘণ্টা আটকা থাকার পর উদ্ধার হয় ১৬ বছরের মাহমুত সালমান। তার ধুলোমাখা হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

ভূমিকম্পের আফটারশকের ভয়ে অনেকে বৃষ্টি ও তুষারপাতের মধ্যে রাত কাটাচ্ছেন। তাঁরা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে আছেন। হাতায় আতাকিয়া নামের এক ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি বলেন, ভূমিকম্প থেকে তাঁরা বেঁচে গেলেও এখন ক্ষুধা ও ঠান্ডায় মৃত্যুর মুখোমুখি।

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশ তুরস্ককে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী ডগ স্কোয়াড নিয়ে অভিযান পরিচালনা করছেন। উদ্ধারে ক্রেনের মতো ভারী যন্ত্রের ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে। তবে তুরস্কের তুলনায় গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ার পাশে বিশ্বের খুব কম সংখ্যক দেশ ও সংস্থা দাঁড়িয়েছে। বিবিসি জানায়, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়ারা সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করছেন। কিন্তু তাদের ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো তেমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ত্রাণ সংস্থা হোয়াইট হেলমেটস ইমার্জেন্সি রেসপন্স গ্রুপ বলছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের বাঁচাতে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে সিরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের প্রতি সহায়তার আহ্বান জানানো হয়েছে।

সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত সালকিন অঞ্চল থেকে আলজাজিরার সোহেইব আল-খালাফ জানান, সেখানে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য কোনো জায়গা খালি নেই। বহু আহতকে হাসপাতালের বাইরে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অধিকাংশই বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। সাংবাদিকরা বলছেন, যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এসব অঞ্চলে রুশ সমর্থিত সরকারি বাহিনী, জিহাদি, তুর্কি সমর্থিত বিদ্রোহী এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই চলছে।

এরই মধ্যে বুধবার তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কাহরামানমারাস পরিদর্শন করেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। এ সময় স্থানীয়রা উদ্ধারকাজে ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরদোয়ান স্বীকার করেন, প্রাথমিক অবস্থায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তবে এখন সুষ্ঠুভাবে উদ্ধারকাজ চলছে। তিনি বলেন, সড়ক ও বিমানবন্দরের কারণে প্রথমে একটু সমস্যা হয়েছে।

তুরস্ক পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোর একটি। ১৯৯৯ সালে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন। এবারের ভূমিকম্পে আরও বেশি প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভূমিকম্পে তুরস্কের হাতায়, উসমানিয়া, আদিয়ামান, মালাতিয়া, সানলিউরফা, দিয়ারবাকির, কিলিস শহর এবং সিরিয়ায় আলেপ্পো, লাটাকিয়া, হামা ও তারতুস বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিখোঁজদের মধ্যে যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকও রয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App