×

জাতীয়

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কতটা কার্যকর হবে নতুন ওষুধ আইন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:১৭ এএম

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কতটা কার্যকর হবে নতুন ওষুধ আইন

ছবি: সংগৃহীত

দেশে কিছু দিন পর পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে উদ্ধার হচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ। আর প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিশেষ করে এন্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে সরকারের কোনো নির্দেশনাই মানা হচ্ছিল না। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। জানানো হয় আইন প্রণয়নের উদ্যোগের কথাও। বিভিন্ন সময় এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে আইনের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। তিনি বলেছেন, এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে আইন হচ্ছে। আমরা একটা আইনের অপেক্ষায় আছি। আইনটা নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। এখানে ব্যবহারের বিষয়ে অনেক নিয়মকানুন থাকবে। এছাড়া সহজে শনাক্তের জন্য এন্টিবায়োটিকের মোড়ক হবে লাল রঙের।

সেই উদ্যোগের পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেল সরকার। ৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে ‘ওষুধ ও কসমেটিক আইন-২০২৩’। আইনে বাজারে ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরির পাশাপাশি নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন করতে যাচ্ছে সরকার। এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রির বিষয়েও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে এই আইনে। এর আগে এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে এবং এই ওষুধ যাতে সহজে চেনা যায় সে জন্য এ ওষুধের মোড়কের বড় অংশজুড়ে লাল রঙে ‘এন্টিবায়োটিক’ লেখার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে।

দেশে অসংখ্য আইন রয়েছে। সেসব আইনে রয়েছে শাস্তির বিধানও। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে জনমনে রয়েছে অসন্তোষ। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া নতুন আইনেও শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে তা বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমাবদ্ধতা থাকলেও আন্তরিকতা ও স্বদিচ্ছা থাকলে এই আইন দ্রুত পাস যেমন হবে তেমনি তা বাস্তবায়নও সম্ভব।

জানা যায়, এর আগে গত বছরের ১১ আগস্ট ওষুধ আইনের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। নতুন আইনে ভেজাল এবং নকল ওষুধ তৈরি করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করলেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আর নিবন্ধন ছাড়া কারখানা থেকে ওষুধ উৎপাদন করলে ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং ১০ বছরের কারাদণ্ড হবে।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ফার্মেসি এন্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি করতে পারবে না। কেউ বিক্রি করলে তার লাইসেন্সও বাতিল হবে। দৃশ্যমান না হলেও এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যে মহামারী রূপ নিচ্ছে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এন্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। যেসব এন্টিবায়োটিক সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত বলে সংস্থাটি বলছে সেগুলো বাংলাদেশে অনেক বেশি ব্যবহার হচ্ছে। যে সব ওষুধের ব্যবহার ৪০ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা উচিত বলে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে তা প্রায় ৭০ থেকে ৮৮ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে। জরুরি এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা যে কমে গেছে তা সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত আরেক রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট।

২০২২ সালের ১৮ মে প্রকাশিত দক্ষিণ কোরিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ জীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক কাজ করছে না। ডায়রিয়া ও মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণে দেশে ব্যবহৃত ১৪টি এন্টিবায়োটিক কোনো না কোনো মাত্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে এম্পিসিলিন ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে আর ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ইমিপেনেম।

আরেকটি ঝুঁকি নিয়েও শঙ্কিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানুষের সঙ্গে-সঙ্গে প্রাণীর ওপরও এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়, যা কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না, মাটিতে রয়ে যায়। এর ফলে আমরা যা খাই, সবজি, ফল বা মাছ মাংস এর মধ্যে থেকে যাওয়া এন্টিবায়োটিকের কারণে আমাদের শরীর এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে থাকে। গবেষণায় বলা হয়, ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ এই ১০ বছরে ৪২টি এন্টিবায়োটিক এলেও ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে মাত্র এসেছে ২১টি। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এসেছে মাত্র ৬ টি এবং ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মাত্র ৯টি নতুন এন্টিবায়োটিক এসেছে। শিগগিরই নতুন কোনো এন্টিবায়োটিক আসার সম্ভাবনাও কম। সতর্ক না হলে বিপদ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

নতুন আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশাবাদী বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যখন কোনো আইন হয়; তখন বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে আসে। যে কোনো আইনের ক্ষেত্রেই ভালো দিক যেমন আছে, তেমনি দুর্বল দিকও আছে। সব দিক বিবেচনা করে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়েই আইন করা হয়। এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে যদি সুফল না আসে তাহলে বড় ধরনের বিপর্যয় নিশ্চিত। এ বিপর্যয় রোধ করতেই যা উদ্যোগ দরকার তা নেয়া হচ্ছে।

নতুন আইনে শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে তা কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব- সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাজটা কঠিন। কে কখন কীভাবে বিক্রি করছেন তা তদারকি করা খুব সহজ কাজ নয়। তবে অসম্ভব নয়। আমাদের মনিটরিং ও সুপারভিশনের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। জনস্বার্থে তদারকি করতেই হবে। কিন্তু তার আগে আমাদের একটি শক্তিশালী আইনতো থাকতে হবে। তারপর প্রয়োগ করতে হবে। আরেকটি বিষয় আমাদের ভুলে গেলে হবে না, জনস্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব শুধুমাত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। এটি মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম। কোভিডকালে সেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, এই আইনটি হচ্ছে একটি ল্যান্ডমার্ক। আমাদের যেহেতু সীমিত জনবল। আর দেশের আনাচে কানাচে ফার্মেসি রয়েছে। তাই যখনই আইনটি সংসদে পাস ও গেজেট হবে দ্রুতই আয়োজন করে ঢাকা মহানগরে তা প্রয়োগ শুরুর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথম ঢাকা মহানগর থেকে কাজটা শুরু হলে গুরুত্ব পাবে। পাশাপাশি এই চাপটা ছড়িয়ে পড়বে দেশজুড়ে। ঢাকাতেই যদি আইন প্রয়োগের কাজটি ২/৩ মাস অব্যাহত রাখা যায় তাহলে সারাদেশের সব দোকানের উপর একটি মানসিক চাপ তৈরি হবে। পর্যায়ক্রমে মহানগরগুলোতে এই আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর যেখানে আইনের বাস্তবায়ন করতে পারবে সেখানে তারা তা বাস্তবায়ন করবে। আর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যতক্ষণ পর্যন্ত নিজস্ব জনবল না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাস্থ্যর জনবল যেমন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা- (ইউএইচএফপিও) তাদের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন তদারকি করতে পারে। মহানগরে ঔষুধ প্রশাসন নিজ দায়িত্বে কাজ শুরু করবে। তাতে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে একটি চাপ তৈরি হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App