×

সারাদেশ

হিসাব লেখা শিখতে স্কুলে ভর্তি হলেন ৬৫ বছরের মান্নান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:০৩ পিএম

হিসাব লেখা শিখতে স্কুলে ভর্তি হলেন ৬৫ বছরের মান্নান

ছবি: ভোরের কাগজ

হিসাব লেখা শিখতে স্কুলে ভর্তি হলেন ৬৫ বছরের মান্নান
হিসাব লেখা শিখতে স্কুলে ভর্তি হলেন ৬৫ বছরের মান্নান
হিসাব লেখা শিখতে স্কুলে ভর্তি হলেন ৬৫ বছরের মান্নান

পড়ালেখা শিখতে ৬৫ বছর বয়সে এসে আবদুল মান্নান নামে এক পান দোকানদার ভর্তি হয়েছেন কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে। প্রথম শ্রেণিতে তার রোল নম্বর ৩৭। বাকি লেনদেনের হিসাব লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা থেকেই বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কাশিয়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের সবার সঙ্গে কথা বলে তাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে নেন। এই বয়সে স্কুলে ভর্তি হতে পেরে বৃদ্ধ আবদুল মান্নান অনেক আনন্দিত।

আব্দুল মান্নান বলেন, অনেক আগেই তার বাবা তছিম উদ্দিন ও মা মুসলিমা বেগম মারা যান। সংসারে সব সময় অভাব লেগেই থাকতো। অনেক কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। ছয় ভাই, এক বোনের মধ্যে ছিলাম তৃতীয়। কখনো লেখাপড়ার সুযোগ পাইনি। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে চোখে পানি চলে আসে।

জীবনসংগ্রামে নানা পেশা বদলে আবদুল মান্নান এখন গ্রামে সড়কের পাশে বসে খিলি পান বিক্রি করেন। কিন্তু পড়াশোনা না জানায় এখানেও নানাভাবে ঠকেন তিনি। অনেকেই তার কাছ থেকে বাকিতে পান কিনে পরে পুরো টাকা শোধ করেন না। অক্ষরজ্ঞান নেই বলে হিসাবও ঠিকমতো রাখতে পারেন না তিনি। সে জন্য জীবনের শেষ প্রান্তিকে এসে পড়ালেখা শেখার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।

ছোটবেলা থেকে দিনমজুরের কাজ করেন। এরপর প্রায় দুই যুগ রিকশা চালান। একসময় বয়সের কারণে রিকশা চালাতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে খিলি পান বিক্রি শুরু করেন। স্থানীয় বাজারে রাস্তার পাশে তার ছোট্ট দোকান। এখানে চার বছর ধরে তিনি খিলি পান বিক্রি করছেন। সকালে বিদ্যালয়ে যান। বিকেলে ছুটির পর দোকানে বসেন।

আবদুল মান্নানের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ি ইউনিয়নের কাশিয়াবাড়ী গ্রামে। ব্যক্তি জীবনে মালেকা ও জান্নাতী নামে দুই মেয়ে ও মমিরুল নামে এক ছেলেসহ তিন সন্তানের জনক তিনি। মেয়েদের বিয়ে হলেও ছেলে মমিরুল পলাশবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষার্থী। বড় মেয়ের ছেলে মাহফুজার বড় হয়ে বিয়ে করেছেন। তার ছেলের নাম কাওসার। যে সম্পর্কে আব্দুল মান্নানের পুতি। সেই পুতির সঙ্গে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন আব্দুল মান্নান।

মান্নানের শ্রেণি শিক্ষিকা সুরভী আকতার বলেন, আমার ১২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এত বেশি বয়সী কাউকে শিক্ষা দেয়নি। তিনি নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন। একজন বৃদ্ধ মানুষকে শেখাতে পেরেও নিজেকে ধন্য মনে করছি।

শিক্ষক মানিক মিয়া জানান, শিক্ষার যে কোনো বয়স নেই, তা আব্দুল মান্নান চাচা প্রমাণ করেছেন। আমরা শিক্ষকরা খুবই খুশি । আমরা তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে সব কিছু শেখানোর চেষ্টা করছি।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে কাশিয়াবাড়ী গ্রাম। একই গ্রামে স্থাপিত বিদ্যালয়টি। পলাশবাড়ী উপজেলা শহর থেকে গ্রামের মেঠো পথ ধরে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। বিদ্যালয়ের তিন দিকে প্রকৃতিঘেরা পরিবেশ। একদিকে কাশিয়াবাড়ী বাজার। পাশে কাশিয়াবাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

সরেজমিন ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নাতি-নাতনির বয়সী শিশুদের সঙ্গে বসে পাঠ গ্রহণ করছেন আবদুল মান্নান। মনোযোগ দিয়ে পড়া শুনছিলেন। কখনো আশপাশে তাকাচ্ছেন। কখনো বই নাড়াচাড়া করছেন।

আবদুল মান্নান জানান, প্রতিদিন সকালে বই-খাতা-কলম হাতে নিয়ে নাতি মাহফুজার রহমানের ছেলে (স্থানীয় ভাষায় পুতি) কাওসার মিয়ার (৬) হাত ধরে বিদ্যালয়ে যান।

ওই বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র আহাদ বলে, আবদুল মান্নান তাদের নানার বয়সী। তারপরও তিনি তাদের সঙ্গে পড়ছেন। তাকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। প্রথম শ্রেণির অন্য ছাত্রছাত্রীরাও একই কথা বলে।

কাশিয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান মণ্ডল বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আমাকে অনুরোধ করে আসছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর তাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে বইও দেয়া হয়েছে। তিনি শিশু শিক্ষার্থীদের মতোই নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসেন। ক্লাসের শিশু ছেলেমেয়েরাও তাকে পেয়ে খুশি।

পলাশবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম মোকসেদ চৌধুরী বলেন, দেরিতে হলেও আবদুল মান্নান লেখাপড়া শেখার প্রয়োজন মনে করেছেন, এটা খুব ভালো উদ্যোগ। এ বয়সে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজে হিসাব রাখতে পারলে তার কাজে লাগবে। তিনি বলেন, এই বৃদ্ধের পড়ালেখার প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে বলা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App