×

মুক্তচিন্তা

বঙ্গদেশ বাইরের নেতৃত্ব মেনে নেয় না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:১৭ এএম

বঙ্গদেশ বাইরের নেতৃত্ব মেনে নেয় না
১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত হয় মুসলিম লীগ। অথচ মুসলিম লীগের একটি কেন্দ্রীয় সম্মেলনও অবিভক্ত বঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়নি। একমাত্র ধর্মীয় ঐক্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একই রাষ্ট্রের বৃত্তে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ ঢাকায় এসে রেসকোর্সে এবং কার্জন হলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দু। উদ্দেশ্য ছিল উর্দু ভাষা বা সংস্কৃতির বলয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে বিলীন করা সম্ভব হলেই পাকিস্তানের দুই অংশের অখণ্ড ঐক্য স্থায়ীকরণ সম্ভব হবে। বাঙালিকে উর্দু ভাষা-সংস্কৃতির বৃত্তে আবদ্ধ করা সম্ভব হলেই দুই হাজার মাইলের ব্যবধানের বিচ্ছিন্নতার স্থায়ী অবসান ঘটবে। বাস্তবে সেটি ঘটেনি। যেটা ঘটেছে, সেটাই ছিল বাস্তবতা। একমাত্র ধর্মীয় বিভাজনে দ্বিজাতিতত্ত্বে ভারতভাগে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিণতি নিয়ে যারা আগাম সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তাদের ওই বার্তা সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির বহু আগে থেকে জিন্নাহর অপরিণামদর্শী রাজনীতির প্রশ্নে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে জিন্নাহর উপলব্ধিরও বহু পূর্বে জিন্নাহর অভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনে কলকাতা এবং ঢাকায় পৃথক দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। ঢাকায় গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ।’ সভাপতি ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন। সম্পাদক তারই জ্ঞাতি ভাই সৈয়দ আলী আহসান। একই সময়ে কলকাতায় গড়ে ওঠে ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি।’ যার নেতৃত্বে ছিলেন মুজীবুর রহমান খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ হবিবুল্লাহ বাহার, আবুল মনসুর আহমদ, জহুর হোসেন চৌধুরী প্রমুখ বিশিষ্টজন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মূলে ছিল বাঙালি মুসলমানদের বিভাজিত সাহিত্য-সংস্কৃতি চেতনা সৃষ্টি। যেটি বাঙালি নয়, বাঙালি মুসলমানদের বিভাজ্য সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রথম সংস্কৃতির বলয় নির্মাণের অপকৌশল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই ভাষা ও সাহিত্যের প্রশ্নে বাঙালি শিক্ষিত কতিপয় বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি পন্থার পক্ষে সাংস্কৃতিকভাবে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তখন থেকেই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার শুরু হয়। এবং সেটা কতিপয় বাঙালি বুদ্ধিজীবীর তৎপরতায়। তাদের চিন্তাভাবনা প্রমাণ করে, আবহমানকালের অবিভাজ্য বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস সৃষ্টির অভিপ্রায় তাদের ছিল না, তারা বাঙালি মুসলমানদের পৃথক সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে বিশ্বাস করতেন। ১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই হায়দারাবাদে মুসলিম লীগ রাজনীতিক চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় পৃথক দুটি পৃথক সমাবেশে জিন্নাহর ঘোষণার পূর্বেই উর্দুর পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ। বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা বলে তা মুসলমানদের জগৎ পরিত্যাজ্য এমন বক্তব্যও প্রকাশ্যে তারা দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেকে। ড. জিয়াউদ্দীনের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে যারা দৃঢ়তর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তাদের পথিকৃৎ প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক আবদুল হক। ১৯৪৭ সালের জুন থেকে আগস্ট মাসে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বেনামে ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমান ১৯৪৯ সালে আরবি বর্ণমালায় বাংলা লেখার পক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে আবদুল হক ‘আরবি হরফে বাংলা’ নামক তির্যক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যেটি ২০ মার্চ ১৯৪৯ সালে দৈনিক ইত্তেহাদে প্রকাশিত হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছিল পাকিস্তানপন্থি কতিপয় বুদ্ধিজীবী। তার সুফল যে তারা অর্জন করতে পারেননি, সেটিও অসত্য নয়। বাঙালি মুসলমান তার জাতীয়তাকে পরিত্যাগ করে সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে প্রধান করে তুলেছিল বলেই পূর্ব বাংলা সহজে পাকিস্তানের একাংশে পরিণত হতে পেরেছিল। বাংলা ও বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির ক্রমাগত চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি পুনরায় জাতিসত্তার চেতনা ফিরে পায়; ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। লেখক, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বদরুদ্দীন উমর যথার্থই বলেছিলেন, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।’ কংগ্রেস রাজনীতিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদও ১৯৪৬ সালে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান না পাওয়া পর্যন্ত কোনো যুক্তি মুসলমানের কানে ঢুকবে না।’ তার কথাটি সত্যে প্রমাণিত হতেও বেশি সময় লাগেনি। ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে মাওলানা আজাদ সাংবাদিক সোরুস কাশ্মিরীকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কিন্তু এ দাবির (পাকিস্তান দাবি) আমি অন্তর্নিহিত বিপদ দেখতে পাচ্ছি।… আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মি. জিন্নাহর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে বঙ্গদেশ। তিনি জানেন না বঙ্গদেশ বাইরের কোনো নেতৃত্ব মেনে নেয় না। আজ কিংবা কাল তারা সে নেতৃত্ব অস্বীকার করবে। আমি মনে করি, পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বহু দিন একসঙ্গে থাকা মোটেই সম্ভব নয়। এই দুই ভূখণ্ডে ধর্ম ছাড়া আর কোনো বাঁধন নেই। আমরা মুসলমান- এই মর্মে কোথাও স্থায়ী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি।’ মাওলানা আজাদের কথা সেদিন দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষাক্ত হাওয়ায় কেউ কানে তোলেনি। মাওলানা আজাদের ন্যায় অনেকেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। মাত্র ২৩ বছরের মধ্যেই তাদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা-ভ্রান্ত বলেই প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান ভেঙে পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে। ধর্মীয় ঐক্যের মাশুল আমরা পাকিস্তানি শাসনামল জুড়ে দিয়েছি। ভয়াবহ রূপে দিয়েছি একাত্তরের ৯ মাসজুড়ে। ধর্মীয় বন্ধনে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৃত্তে একাকার করা যে অসম্ভব। সেটা পাকিস্তানপন্থি বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সে কারণেই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৫ বছর পূর্বেই বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি চেতনা বিলোপে কলকাতায় এবং ঢাকায় গঠন করেছিলেন পৃথক দুটি সংগঠন। মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি থেকে বাঙালি মুসলমানদের বিযুক্ত করে উর্দু ভাষা-সংস্কৃতির অভিমুখে ঠেলে দেয়া। যেটি পাকিস্তান স্রষ্টা জিন্নাহ বুঝেছিলেন ১৯৪৮ সালে। সেটি বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ১৯৪২ সালেই তাদের অগ্রবর্তী চিন্তায় উপলব্ধি করেছিলেন। তাদের সেসব উদ্যোগের সাফল্য পেয়েছিল ১৯৪৬-এর নির্বাচনে। বাঙালি আর তখন বাঙালি ছিল না। জাতীয়তার পরিবর্তে সম্প্রদায়গত পরিচয়কে প্রধান করে তুলেছিল। যার কারণে ভ্রাতৃপ্রতিম দুই সম্প্রদায়ের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘটনে দেশভাগ সম্পন্ন হতে পেরেছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালনকে কেন্দ্র করেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা রক্তপাতের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং রক্তপাতেই রাষ্ট্রের ভাঙন সম্পন্ন হয়েছে। আগামীতেও পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আবার রক্তক্ষয়ী পথে ভেঙে খণ্ড-বিখণ্ড হলে অবাক-বিস্ময়ের কারণ হবে না। ধর্ম পরিবর্তন সহজ। যেটি মানুষের পক্ষে পরিবর্তন করা তাৎক্ষণিক ব্যাপার মাত্র। কিন্তু জাতীয়তা পরিবর্তন কেবল অসহজই নয়, অসম্ভবও। তাই জাতীয়তার ভিত্তি অধিক শক্তিশালী এবং স্থায়ীও বটে। বিজাতীয় সংস্কৃতির বলয়ে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতিবান জাতির সংস্কৃতিকে সহজে পরাভূত করা যায় না। ধর্ম পরিবর্তন করা যায় সহজে, কিন্তু সংস্কৃতির বিনাশ ঘটানো যায় না। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বাংলা-বাঙালিকে যথার্থই চিনতে ও বুঝতে পেরেছিলেন বলেই দার্শনিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মন্তব্যটি করেছিলেন- ‘বঙ্গদেশ বাইরের নেতৃত্ব মেনে নেয় না। ক্রমেই বহিরাগত নেতৃত্ব অস্বীকার করবে।’ বাঙালি জাতি নিজেদের জাতীয়তা রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগের ইতিহাস গড়েছে। যেটি বিশ্বে বিরল ঘটনা রূপেই প্রতীয়মান। বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব-বীরত্ব ইতিহাসের নানা পর্বে প্রমাণিত। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App