×

জাতীয়

পাঁচ ভোগ্যপণ্যে রোজার আঁচ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৪৪ এএম

পাঁচ ভোগ্যপণ্যে রোজার আঁচ

ছবি: সংগৃহীত

রমজান সামনে রেখে চিনি, ছোলা, খেজুর, ভোজ্যতেল ও মসলার দাম দফায় দফায় বাড়ছে

রমজান আসতে আরো প্রায় দেড় মাসের মতো বাকি। এরই মধ্যে বাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন পাঁচ পণ্য- চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ছোলা ও খেজুরের উত্তাপ বাড়ছে। রমজানের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সন্তোষ প্রকাশ করলেও আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। বরাবরের মতো এবারও অসাধু ব্যবসায়ীদের অপকর্মে অস্থিতিশীল হতে শুরু করেছে বাজার। দুশ্চিন্তা বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এদিকে খেজুর, ছোলা, ভোজ্যতেল, চিনিসহ আটটি নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংক, আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানিকারকরা বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের আমদানি স্বাভাবিক থাকার কথা জানালেও ভরসা পাচ্ছে না মানুষ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সারা বছরের নিত্যপণ্য আমদানি ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশই রমজানের পণ্য আমদানিতে খরচ হয়। তবে ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানি বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছে। এ জন্য পরিস্থিতি সামলাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রমজানের পণ্য আমদানির চাহিদা মেটাতে আলাদাভাবে ডলার সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করেছে। এর মধ্যে রমজানের চাহিদার প্রায় সমপরিমাণ এলসি ইতোমধ্যে খোলা হয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকেই রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা শুরু হয়। সূত্র মতে, বড় চার কোম্পানি এ সুযোগ পেয়েছে। রমজানের পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দুইবার বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়। বর্তমানে বাণিজ্য সচিব ও টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রাজিলে আছেন সয়াবিন তেল আমদানির বিষয়ে আলোচনা করতে। এছাড়া ভারত থেকে টিসিবির জন্য মসুর ডাল আনা হয়েছে।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, রমজানে সাধারণত নিত্যপণ্যের চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় দুই থেকে আড়াই গুণ বেড়ে যায়। একটা অসাধু ব্যবসায়ী চক্র এই সুযোগ নিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে পণ্যের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এ জন্য বাজার ঠিকমতো মনিটরিং করা দরকার। এদিকে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, ডলারের দাম বাড়ার কারণে এবার রোজায় আমদানি করা পণ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়বে। তবে অন্যতম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা ভোরের কাগজকে বলেন, ডলার সংকটে আমরা এখনো পর্যাপ্ত এলসি খুলতে পারিনি। তবে রমজানে বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি হবে কিনা তা নির্ভর করবে সে সময়ের বাজারমূল্যের ওপর।

সরকারের আরেক সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রোজার দেড় মাস আগেই গত বছরের তুলনায় আমদানি করা পণ্যের দাম গড়ে ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের দেয়া তথ্য মতে, গত ২০ থেকে ২৫ দিনে মানভেদে ছোলা মণপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। একই সময়ে ডাল বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা, মণপ্রতি চিনি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, এছাড়া সব ধরনের মসলার দাম বেড়েছে। এর মধ্যে এলাচি কেজিপ্রতি ২০০ টাকা এবং কেজিপ্রতি জিরা প্রায় ১৫০ টাকা বেড়েছে। তাছাড়া মরিচের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা কমলেও ধনিয়া ও হলুদের দাম স্থিতিশীল। আর আদা-রসুনের দাম বাড়লেও খাতুনগঞ্জে বিদেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ২২ থেকে ৩২ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ২৮ টাকার মধ্যে।

বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, গত কয়েক দিনে খেজুরের দাম মান অনুযায়ী কেজিতে ১০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে বাজারে হরেক রকম খেজুর পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- আম্বার, কালমি, মরিয়ম, শুককারি, ছড়া, বাটি, ছক্কা, কাউন দাবাস, সুগাই, গাওয়া, তিনপল, মাজদুল, জিদাহি, সায়ের, মাসরুক, আদম, ম্যাকজুয়েল, মাবরুল প্রভৃতি।

চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ জাহেদী বলেন, রমজানে পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়বে। এর কারণ হলো, আগে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ৮৫-৮৬ টাকা হলেও বর্তমানে তা ১০৭ টাকা হয়েছে। আর ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমেছে ৩০-৩৫ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা রমজান উপলক্ষে আগাম প্রস্তুতি নিতে পারেননি। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীরা বিকল্প হিসেবে ভারত ও মিয়ানমার থেকে রমজানের পণ্যর আনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই সহজে এসব দেশ থেকে পণ্য আনতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, রমজান মাসকে কেন্দ্র করে পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে। এর পরিমাণ গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় অনেক বেশি। তারপরও বিভিন্ন মাধ্যমে এলসি খোলার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন। তিনি জানান, রমজান মাসে পাঁচটি পণ্যের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। আর বাজার স্বাভাবিক রাখতে এসব পণ্য আমদানিতে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা যায়, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৮ লাখ টন। তার মধ্যে রোজায় চাহিদা থাকে ৩ লাখ টনের। ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২১ লাখ টন। তার মধ্যে রমজানের চাহিদা ৪ লাখ টন। মসুর ডালের বার্ষিক চাহিদা ৫ লাখ টন, রোজায় এই পণ্যের চাহিদা ৮০ হাজার টন। ছোলার বার্ষিক চাহিদা প্রায় দেড় লাখ টন, রোজার চাহিদা ৮০ থেকে ৯০ হাজার টন। পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন; এর মধ্যে রোজার চাহিদা ৫ লাখ টন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, এ বছর জানুয়ারিতে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৪১ টন চিনির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এক বছর আগে একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ৪৯৩ টন। এ বছরের জানুয়ারিতে ৫৪ হাজার ৪৪৮ টন বেশি চিনির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। একইভাবে ভোজ্যতেল আমদানির জন্য ৩ লাখ ৯০ হাজার ৮৫৩ টনের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ৯৬০ টন। এ বছর ২ লাখ ২৪ হাজার ৫৬৭ টন ছোলা আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। এক বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৬ টন। অর্থাৎ এ বছরের জানুয়ারিতে ছোলার এলসি কিছুটা কমেছে। ৪২ হাজার ৫৬৩ টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খুললেও গত বছরের একই সময় ছিল ৩৬ হাজার ২২৬ টন। এ বছর ২৯ হাজার ৪৮২ টন খেজুরের ঋণপত্র খোলা হয়েছে, আগের বছর যার পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৪৯৮ টন।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও আমদানিকারক মো. মহিউদ্দিন বলেন, বেচাকেনা একদম নেই, তবে পণ্যের সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু গত বছরের দামে পণ্য পাওয়া যাবে না। যদি সামনে সরবরাহ বাড়ে তবে আশা করি, দাম আরো কমবে।

এলসির বিষয়ে তিনি বলেন, বড় ব্যবসায়ী থেকে পণ্য নিয়ে মাঝারি-ছোট ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন। কারণ ডলার সংকটের কারণে এবার তারা ছোটখাটো এলসি খোলে পণ্য আমদানি করতে পারেননি। তবে রমজানে পণ্যের সংকট হবে না। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বলেন, রমজানসহ নিত্যপণ্যের এলসি খোলায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যারা আসছে, প্রত্যেকের এলসি খোলা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App