×

মুক্তচিন্তা

গ্যাসের লাফ : বিদ্যুতের ফাল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:২৫ এএম

নিত্যপণ্যের সঙ্গে লম্পজম্প গ্যাস-বিদ্যুতেরও। এ যেন এক আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা। ডিম-মুরগি, ডাল-তেল, আটা-ময়দাসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের বাজার আরো অস্থির। গতকালের চেয়ে আজ আরো তেজি। আজকের চেয়ে আগামীকাল আরো বেশি। অজুহাতের শেষ নেই বিক্রেতাদের। সরকারকে গালমন্দ করা ছাড়া করণীয় আর কিছু নেই অসহায় ক্রেতাদের। এর মাঝে ১৯ দিনের ব্যবধানে আবারো বাড়ানো হলো পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের বিদ্যুতের দাম। গ্যাসই বা বাদ থাকবে কেন? বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। কিন্তু কমিশন নির্ধারিত দামে কোথাও সিলিন্ডার গ্যাস মিলছে না। ডলার, বিশ্ব^ পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন সংকটের অজুহাতে অতিরিক্ত ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত লুটে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। নৈরাজ্যের চরমে চলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। এক মাসে ৩ বার, আর ১৪ বছরে ১১ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো পর্যন্তই দৃষ্টান্তের শেষ নয়। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা। ভর্তুকি কমানোর দোহাই দিয়ে দাম সমন্বয় হলেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের দেখা নেই। খুচরা গ্র্রাহকের ভোগান্তির সমান্তরালে সরবরাহ সংকটে বানরের বাঁশে ওঠার লড়াইয়ের দশায় পড়েছে শিল্প খাত। যা অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সরকারি পর্যায়ের পরিকল্পনাকে মাঠে মারার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। করোনার ধাক্কা ও বিশ্ব অর্থনৈতিক অস্থিরতার জেরে এমনিতেই দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। কমেছে কর্মসংস্থান, বেড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা। এমন দুর্গতির সন্ধিক্ষণে নতুন বছরের শুরুতেই এক মাসে চারবার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিষ্ঠুর তামাশার নামান্তর। দাম বৃদ্ধির পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৪ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ছিয়াত্তর শতাংশ। সাড়ে ৩ টাকার এক ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে গ্রাহকের খরচ এখন ৮ টাকা। ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারী লাইফ লাইন গ্রাহকের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে গ্যাসভিত্তিক উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে আবাসিকের দুই চুলার ৪৫০ টাকার গ্যাস বিল এখন ১ হাজার ৮০ টাকা। শিল্প খাতে একবারেই বেড়েছে ১৭৯ শতাংশ। গণশুনানির মাধ্যমে জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ের প্রথাটিও সংকুচিত করে এনেছে সরকার। নির্বাহী আদেশেই সমন্বয়ের নামে যাবতীয় ক্ষমতা সরকারের কব্জায়। দুর্নীতি-অপচয় কমানোর উদ্যোগ না নিয়ে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোকেই সহজ পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে সরকার। বৈশ্বিক যন্ত্রণা, ডলার সংকট- সব মিলিয়ে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যেই গেল বছর ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছিল ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তখনই গ্রাহক পর্যায়েও দাম বৃদ্ধির বার্তা মিলছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ১২ জানুয়ারি একবার পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। ২৯ জানুয়ারি সংসদে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সংশোধন বিল পাসের একদিন পর দাম বাড়ল আবারো। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির এমন ঘোষণা নিয়মিতই আসতে থাকবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা কাহাতক? এ প্রশ্নের জবাবের বদলে জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুতের পর এবার রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে সিলিন্ডার গ্যাসের দাম। ঢাকাসহ দেশের প্রান্তিক এলাকায়ও বিপুলসংখ্যক মানুষ এলপিজির ওপর নির্ভরশীল। বেসরকারি এলপিজি অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা গ্রাহক প্রায় ৫০ লাখ। চলতি মাসের জন্য প্রতি সিলিন্ডার এলপিজির দাম ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। যা গত মাসে ছিল ১ হাজার ২৩২ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে এলপিজির দাম বেড়েছে ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। শুধু বাসাবাড়িতে নয় গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে খাবার হোটেলেও। নিয়ন্ত্রণহীন বাজার থেকে পণ্য কিনে সর্বোচ্চ দামের গ্যাসে রান্না করে নিভু নিভু ব্যবসার কথা জানান হোটেল সংশ্লিষ্টরা। চলতি বছরের প্রথম মাসেই কয়েক দফায় দাম বাড়ানোর পর গ্যাস-বিদ্যুৎ এখন লম্ফঝম্পের প্রতীকী নাম হয়ে গেল। দাম বৃদ্ধির এই চাপ মানুষের জীবন-জীবিকার সরল অঙ্ককে গরলের চরমে নিয়ে যাচ্ছে। একে সুযোগ হিসেবে নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী তাদের চিরচেনা স্বরূপে মূর্তিমান হয়ে উঠেছে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কয়েকশ টাকা অতিরিক্ত আদায়ে দেখাচ্ছে নানা অজুহাত। গ্রাহক তাদের কাছে অসহায়-জিম্মি। দেশের কোথাও কোথাও কেবল দাম বেশি হাঁকানো নয়, অনেক দোকান এলপিজির সিলিন্ডার বিক্রি বন্ধই করে দিয়েছে। তাদের হাতে-পায়ে ধরছে গ্রাহক-ক্রেতারা। কোথাও কোথাও ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানে নামায় বিক্রেতারা আরো চটেছে। বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছে। এতে কেবল গ্রাহক নয়, এক অর্থে তারা সরকারকেও কাবু করে ফেলেছে। গ্যাসের দাম বাড়াতে কয়েক মাস থেকে কৃত্রিম সংকটের কথা রটেছিল। সেই রটনা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এর মাধ্যমে গ্যাসের দাম নিজেদের মতো করে বাড়ানোর সক্ষমতায় বলীয়ান বিক্রেতারা। জনগণের সঙ্গে সরকারও এখন তাদের শিকারে পরিণত। কয়েক বছর ধরেই দেশে নতুন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের সংযোগ দেয়া বন্ধ। এতে দেশের বড় একটি অংশের মানুষ এলপিজি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দিন দিন বড় হতে থাকে এলপিজির বাজার। এলপিজি মূলত একটি আমদানি পণ্য। এটি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন আনা হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। প্রতি মাসে এলপিজির উপাদান দুটির দাম প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এটি সৌদি কার্গো মূল্য-সিপি নামে পরিচিত। সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি। বেসরকারি এলপিজির মূল্য সংযোজন করসহ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি প্রায় ১২৫ টাকা, যা এত দিন প্রায় ১০৩ টাকা ছিল। গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজি-অটো গ্যাসের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি লিটার প্রায় ৭০ টাকা, যা এত দিন ৫৭ টাকার কিছু বেশি ছিল। সরকারি কোম্পানির সরবরাহ করা এলপিজির দাম বাড়ানো হয়নি। সরকার গত ১৮ জানুয়ারি প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ৮২ শতাংশ বাড়ালেও বাসাবাড়িতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। বাসায় দুই চুলার ক্ষেত্রে মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ টাকা এবং এক চুলার ক্ষেত্রে ৯৯০ টাকা। এর মধ্যেই ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির দাম এক লাফে ২৬৬ টাকা করা আপদের মাঝে বিপদে ফেলেছে মানুষকে। চলতি ফেব্রুয়ারির জন্য প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দর ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ অনেককে জ্যান্ত আধমরা করে দেয়ার মতো। তার ওপর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকট দিনকে দিন সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাস থাকছে না। কোথাও কোথাও থাকলেও তা নিভু নিভু মোমের বাতির চেয়েও দুর্বল। কোনো এলাকায় গভীর রাতে গ্যাস এলে রান্না সারতে হচ্ছে। গ্যাসের চুলায় আগুন থাক না থাক, রান্না হোক না হোক, মাস শেষে নির্ধারিত গ্যাস বিল দিতেই হচ্ছে। আবার লাকড়ি, ইলেকট্রিক চুলা, রাইস কুকার, স্টোভ বা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করায় বাড়তি খরচও গুনতে হচ্ছে। শীত শেষে গ্রীষ্মে এ ভোগান্তির মাত্রা কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে ভেবে কুলকিনারা মেলে না। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য এটি অশনি সংকেত। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এখন সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করার ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, ফলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে ঘাটতিতে থাকা পিডিবির আরো ঘাটতি অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যা বিদ্যুতের দাম আরো বাড়ানোর আগাম বার্তা। এতে রাষ্ট্রও কি স্বস্তিতে থাকবে? জনগণের টাকা সরকারি সংস্থার কাছে গেলেও সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাড়তি দামে এলএনজি কেনা সম্ভব হবে কিনা- এ নিশ্চয়তাও নেই। এলএনজি আমদানির জন্য প্রয়োজন ডলার। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই উপলব্ধি করা যায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত খাতের পরিকল্পনা আমদানিনির্ভর হলে ঝুঁকিতে পড়ে যায় জ্বালানি নিরাপত্তা। এমনিতেই ডলার সংকটের কারণে সময়মতো কয়লা আমদানি করতে না পারার কারণে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে বাড়তি এলএনজি আমদানির কথা বলে গত চার বছরে কয়েকবার গ্যাসের দাম বাড়িয়েও এলএনজি আমদানি বাড়ানো যায়নি। বরং ডলার সংকটের কারণে আরো কমেছে। বাস্তবতাটি কঠিন। দাম বাড়ালেই গ্যাস সংকটের সমাধান হয়ে গেলে তা কবেই হয়ে যেত। সাড়ে ১৩ বছরে ছয়বার গ্যাসের ৪০০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ফল গ্যাস সরবরাহের মধ্যে দেখা যায়নি। দেশে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে না পারলে সপ্তায় সপ্তায় দাম বাড়ালেও এ নিষ্ঠুর তামাশা চলতেই থাকবে। এ ক্ষেত্রে দেশে জ্বালানি সংকটে সাময়িক স্বস্তি হিসেবে আশার আলোর দেখাচ্ছে ভোলার গ্যাস। সম্ভাব্য মজুত ও বাপেক্সের জরিপ বলছে, দীর্ঘমেয়াদেও গ্যাস সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে ভোলার গ্যাসক্ষেত্রগুলো। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনটি ক্ষেত্র থেকে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করার কথা জানিয়েছে বাপেক্স। আগামী দুই মাসের মধ্যে ভোলার গ্যাস বোতলজাত সিএনজি আকারে শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা সম্ভব হলে মরুর মাঝে দুই ফোঁটা শিশির বিন্দুর পরশ মিলতেও পারে। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App