×

স্বাস্থ্য

নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ৩৩ জেলায়, মৃত্যু ৭০ ভাগ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৭ এএম

নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ৩৩ জেলায়, মৃত্যু ৭০ ভাগ

ছবি: সংগৃহীত

বন উজাড় করার কারণে বিশ্বব্যাপীই প্রাণীবাহিত রোগের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। নিপাহ ভাইরাস তেমনি একটি রোগ। বিশ্বমারি ঘটাতে সক্ষম নিপাহ ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ। যার প্রাদুর্ভাব শীতকালীন জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি সমস্যা। ইতোমধ্যেই দেশের ৩০টির বেশি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগটি। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ। কখনো কখনো শতভাগও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩৫ দিনে মোট ১০ জন এই ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়েছেন। যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। সংক্রমণ রোধে বাড়তি সতর্কতা নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। হাসপাতালগুলোতে বাড়তি সতর্কতা ও প্রস্তুতির নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এই সময়টাতেই খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা, অনেক সময় প্র¯্রাবও মিশে যায়। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে, মানুষের মধ্যেও এই রোগ ছড়িয়ে পারে। এছাড়া বাদুরে খাওয়া ফলমূলের অংশ খেলেও এ রোগ ছড়াতে পারে।

রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, কাঁচা রস পান করা মোটেও নিরাপদ নয়। এক্ষেত্রে রসটি ফুটিয়ে খেলে ঝুঁকিমুক্ত থাকা সম্ভব। রস সংগ্রহের পর আগুনে ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে কিছু উত্তপ্ত করলেই ভাইরাস মরে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, নিপাহ ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। পরে সেটি মানুষে মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেজুরের কাঁচা রস পান না করার বিষয়ে বারবার সতর্ক করার পরও মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসেনি। আর সে কারণেই এ বছর নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। এখনই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে।

চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্ত ব্যক্তির বা পশুর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার ২ সপ্তাহের মধ্যে মৃদু থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট, জ্বরসহ মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, খিঁচুনি, জ্ঞান হারানোর মতো লক্ষণ দেখা দিলে ওই ব্যক্তি নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়। কোন সালে কত রোগী : স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার ‘সুঙ্গাই নিপাহ’ গ্রামে প্রথম এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা যায়, শূকর থেকেই নিপাহ ভাইরাস ছাড়িয়েছে। ভাইরাসটি আবিষ্কার করেন ড. কো বিং চুয়া। এই ভাইরাস বাংলাদেশে শনাক্ত হয় ২০০১ সালে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) আক্রান্ত এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয়, বাদুড়ই নিপাহ ভাইরাস খেজুরের রসে ছড়িয়ে দিয়েছে।

খেজুরের রসের হাঁড়িতে বাদুড়ের মল লেগে থাকতে দেখা যায়। ওই বছর ১৩ জন শনাক্ত হন। তাদের মধ্যে ৯ জন মারা যান। আইইডিসিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২২ বছরে (২০০১-২০২৩) ৩৩৫ জন নিপাহ ভাইরাসে শনাক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৩৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬, ২০০৬ ও ২০০২ সালে এই ভাইরাসে শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল শূন্য। বছরভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত ১০ জন নিপাহ ভাইরাসে শনাক্ত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালে শনাক্ত ৩ জনের মধ্যে ২ জনেরই মৃত্যু হয়। ২০২১ সালে ২ জন শনাক্ত হলেও মৃত্যু ছিল শূন্য। ২০২০ সালে শনাক্ত ৭ জনের মধ্যে মারা গেছে ৫ জন। ২০১৯ সালে শনাক্ত ৮ জনের মধ্যে ৭ জন, ২০১৮ সালে ৪

জনের মধ্যে ২ জন, ২০১৭ সালে ৩ জনের মধ্যে ২ জন, ২০১৫ সালে ১৫ জন শনাক্তের মধ্যে ১১ জন মারা যান। ২০১৪ সালে ৩৭ জন শনাক্ত ও ১৬ জন, ২০১৩ সালে ৪১ জন শনাক্ত ও ২৫ জন, ২০১২ সালে ১৭ জন শনাক্ত ও ১২ জন, ২০১১ সালে ৪৩ জন শনাক্ত ও ৩৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১০ সালে শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৮ জন ও ১৬ জন, ২০০৯ সালে ৪ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু, ২০০৮ সালে শনাক্ত ১১ জনের মধ্যে ৭ জন, ২০০৭ সালে ১৮ জনের মধ্যে ৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৫ সালে ১২ জন শনাক্ত ও ১১ জন, ২০০৪ সালে ৬৭ জন শনাক্তের মধ্যে ৫০ জন, ২০০৩ সালে ১২ জন শনাক্তের মধ্যে ৮৭ জনের মৃত্যু হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা : ২ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শেখ দাউদ আদনান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ পর্যন্ত দেশের ৩২টি জেলা নিপাহ ভাইরাসজনিত জ্বরের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের প্রতি হাসপাতালে জ্বরের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য কর্তব্যরত চিকিৎসকদের বেশ কিছু নির্দেশনা অনুসরণ করে চিকিৎসাসেবা দেয়ার অনুরোধ করা হয়। নির্দেশনাগুলো হলো- রোগী দেখার সময় অবশ্যই মাস্ক পড়তে হবে। রোগী দেখার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। জ্বরের উপসর্গ দেখা গেলে রোগীকে অবশ্যই আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি রাখতে হবে।

জ্বরের সঙ্গে সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা দিলে রোগীকে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের আইসিইউতে রাখতে হবে। আইসিইউতে থাকাকালীন রোগীর পরিচর্যাকারীদের শুধু গ্লাভস, মাস্ক পরলেই হবে। কেননা, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর কাছ থেকে বাতাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায় না। যেহেতু আইসিইউতে রেখে এই রোগীর চিকিৎসা করা যায়, এজন্য রেফার্ড করার প্রয়োজন নেই। কোনো ধরনের তথ্যের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কল সেন্টারে ১৬২৬৩/৩৩৩ যোগাযোগ করার পরামর্শ দেয়া হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে। এর আগে ৩০ জানুয়ারি ডা. শেখ দাউদ আদনান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ায় মহাখালীর কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালের ১০ বেড আইসোলেশন ওয়ার্ড ও ১০টি আইসিইউ বেড প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, খেজুর রস আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু এটিও মনে রাখতে হবে, এ রসের সঙ্গে নিপাহ ভাইরাসের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই কোনো অবস্থাতেই কাঁচা খেজুরের রস পান করা যাবে না। এই রোগের কোনো টিকা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই সাবধানতা অবলম্বনের বিকল্প নেই।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, নিপা ভাইরাসে যদিও কমসংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয় কিন্তু যারা এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয় তাদের মধ্যে অন্তত ৭০ ভাগের মৃত্যু ঘটে। কখনো কখনো শতভাগেরই মৃত্যু হয়। দেশের ৩৩ জেলায় নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। ২০০১ সাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত দেশের ৩৩টি জেলায় কোনো না কোনো সময় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এসব জেলার বেশি সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তবে সারা বাংলাদেশেই সতর্ক থাকতে হবে। কেননা, সারাদেশেই খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া হয়। নিপাহ হচ্ছে এমন একটি ভাইরাস যা বিশ্বমারি ঘটাতে সক্ষম। তাই আমাদের সতর্ক হতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App