×

জাতীয়

রোগী বাড়লেও সেবা সীমিত, চিকিৎসা ব্যয়ে নিঃস্ব পরিবার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৪০ এএম

রোগী বাড়লেও সেবা সীমিত, চিকিৎসা ব্যয়ে নিঃস্ব পরিবার

ছবি: সংগৃহীত

দেশে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে ক্যানসার রোগীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা আশঙ্কাজনক। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণা বলছে, দেশে প্রতিবছর আড়াই লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে।

এর জন্য খাদ্যাভ্যাস আর অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন, খাদ্যে ভেজাল আর বায়ুদূষণকে দায়ী করছেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা। তবে উদ্বেগের কথা হচ্ছে আক্রান্তদের বেশিরভাগই চিকিৎসার আওতার বাইরে থাকছে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা আর ঢাকাকেন্দ্রীক সেবার কারণে অনেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব পরিবারে ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়েছে তাদের প্রায় ১৭ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ক্যানসার চিকিৎসায় দেশে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব, রোগ শনাক্তে সারাদেশে ব্যবস্থা না থাকা আর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসায় রেফারেল সিস্টেমসহ কোনো গাইডলাইন না থাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসায় বিশেষায়িত এবং সমন্বিত চিকিৎসার সুযোগ সম্বলিত একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। বিভাগীয় পর্যায়ে এখনো বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় রোগীদের ঢল নামে রাজধানীতে। তবে দেশে ২৭ ধরনের ক্যানসার রোগীদের জন্য এখানে রয়েছে মাত্র ৩শ বেডের হাসপাতাল। এতে চিকিৎসাসেবার নাগাল পেতে যে সময় লাগছে তার আগেই ক্যানসার ছড়িয়ে যাচ্ছে ভুক্তভোগীর পুরো শরীরে।

গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি পর্যায়ে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর একটি রেডিওথেরাপি সেশনের জন্য ২৫ হাজার টাকা, কেমোথেরাপির জন্য ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। অনেক সময় রোগীর জন্য একটি রেডিওথেরাপি সেশন, ৬টি কেমোথেরাপি সেশন এবং অস্ত্রো পচারও করতে হয়। এর জন্য সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা প্রয়োজন হয়। ক্যানসার রোগীদের প্রায় ৫০ শতাংশের এই ৩টি চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। ২০ শতাংশের যে কোনো দুটি পদ্ধতির প্রয়োজন হয়, আর ৩০ শতাংশের একটি একক পদ্ধতির প্রয়োজন হয়।

২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোস্যাল এন্ড এডমিনিস্ট্রেটিভ সায়েন্সেস’ এ ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ও ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও গবেষণা হাসপাতালের এপিডেমিওলজি বিভাগের তৎকালীন প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন এবং আরো দুজনের সমন্বয়ে এই সমীক্ষা চালানো হয়।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে যারা ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছে তাদের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, একজন রোগীর পেছনে সাড়ে ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এই খরচ মূলত ক্যানসারের ধরনের ওপর অনেকটা নির্ভর করে। আমরা যদি ধরে নেই গড়ে ৭ লাখ টাকার মতো খরচ হচ্ছে, তাহলে এই বিশাল খরচের কারণ হিসেবে বলব আমাদের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকা। আমরা দেখছি, একজন রোগীর রোগ শনাক্ত হওয়া পর্যন্ত যেতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। একজন রোগীকে তার ক্যানসার শনাক্তের আগেই লাখ লাখ টাকা এদিক-সেদিক খরচ করতে হচ্ছে উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে ক্যানসারের পরীক্ষা সহজলভ্য না থাকার কারণে। এই লাখ টাকা খরচ করার আগেই যদি ব্যক্তির ক্যানসার শনাক্ত হয়ে যেত, এবং সে যদি তখনই ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু করতে পারত, তাহলে তার সময় ও অর্থ সাশ্রয় হতো। আমাদের বিভাগীয় ৮টি মেডিকেলে যদিও রেডিওলোজি বিভাগ আছে, কিন্তু সেখানে ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ কতটা আছে তা সবারই জানা। ৮ বিভাগে ক্যানসার হাসপাতাল করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এসব হাসপাতাল যত দ্রুত নির্মিত হবে এবং কাঙ্খিত সেবা যদি মিলে তাহলে রোগীদের স্বস্তি ততটাই হবে।

তবে ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিশ্বমানের ক্যানসার সেবা দেয়া হচ্ছে এটি যেমন সত্য তেমনি ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসায় প্রতিষ্ঠান, যন্ত্রপাতি জনবল সংকটও রয়েছে। বিশ্বে প্রতি বছর যে হারে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তা কমিয়ে আনতে হলে শুধুমাত্র চিকিৎসা সেবার উপর জোর দিলেই হবে না। রোগীর সংখ্যা যাতে না বাড়ে সেই কাজটিও করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। দেশে সরকারি উদ্যোগে জাতীয় ক্যানসার স্ক্রিনিং কার্যক্রম চালুরও তাগিদ দেন তারা।

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, দেশে জাতীয়ভাবে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই। বাংলাদেশ সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে অন্যান্য রোগের মতো জনগণের ক্যানসারসেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছে। এরপরও প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার রোগী নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্য থেকে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার রোগীই মারা যাচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনার জন্য সঠিক পরিসংখ্যান দরকার।

শুধুমাত্র জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে হাসপাতালভিত্তিক নিবন্ধন চালু আছে, কিন্তু জনগোষ্ঠীভিত্তিক নিবন্ধন এখনো চালু করা যায়নি। এ কারণে দেশে ক্যানসার আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারসহ গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান নেই।

এই প্রেক্ষাপটে আজ ৪ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যানসার দিবস। ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ব ক্যানসার দিবস পালন শুরু হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর ক্যানসার কন্ট্রোল (ইউআইসিসি) ২০২২, ২০২৩ এবং ২০২৪- এই তিন বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘আসুন ক্যানসার সেবায় বৈষম্য দূর করি’। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচিতে দিবসটি পালিত হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App