×

শিক্ষা

কমলগঞ্জে বৃন্দারাণীর মণিপুরী বর্ণমালায় মাতৃভাষায় স্কুল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:১৩ পিএম

কমলগঞ্জে বৃন্দারাণীর মণিপুরী বর্ণমালায় মাতৃভাষায় স্কুল

ছবি: ভোরের কাগজ

মৌলভীবাজারের মণিপুরী জাতিগোষ্ঠীর লোকজন নিজেদের মধ্যে কথ্যভাষা ব্যবহার করলেও বেশির ভাগেরই নিজস্ব বর্ণমালার সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই। মণিপুরী শিশুরা বড় হচ্ছে, যে ভাষার আলিঙ্গনে সে ভাষাটিকে খুঁজে পায় না বিদ্যালয়ে। একই বিদ্যালয়ে বাঙালি শিশুরা যখন পড়াশোনা করছে তার চিরচেনা মায়ের ভাষায়, তখন মণিপুরী শিশুদের মনে আগ্রাসী হিসেবে চেপে বসে বাংলা ভাষাটি। মাতৃভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ও শিক্ষালাভের অধিকার বঞ্চিত মণিপুরী সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে।

তাই নিজের ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করে যাচ্ছেন বৃন্দারাণী নামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। বিদ্যালয়ে প্রচলন নেই মণিপুরী ভাষাটির, নেই মণিপুরী ভাষার বইও। বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করা বই দিয়ে বৃন্দারাণী মণিপুরী শিক্ষার্থীদের তাদের মাতৃভাষায় দক্ষ করে তুলছেন বলে জানান অভিভাবকরা।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মণিপুরী পরিবারে বৃন্দারাণীর জন্ম। পুরো নাম ওজা বৃন্দারাণী সিনহা। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের হকতিয়ারখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকার চাকরি করেই উজ্জ্বল দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি মণিপুরী বর্ণমালা স্কুল প্রতিষ্ঠা করে মাতৃভাষা টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন।

মায়ের মুখে শোনা মণিপুরী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ইমালোন ভাষাটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ২০১৯ থেকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের হকতিয়ারখোলায় নিজ বাড়িতে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নিজ উদ্যোগে বিনা বেতনে এটি পরিচালনা করে আসছেন প্রায় চার বছর ধরে।

বর্তমানে মোট পঁয়ত্রিশ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছে এবং নানা বয়সের ২১ জন মহিলাকেও তিনি পাঠদান করে থাকেন। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে মণিপুরী বর্ণমালা শেখার। নতুন দুয়ার খুলেছে গবেষণারও।

হকতিয়ারখোলা গ্রামে বৃন্দারাণীর সঙ্গে আলাপ হয়। তার কথায় জানা গেল বাংলাদেশে মণিপুরী ভাষার প্রায়োগিক ক্ষেত্র যেমন নেই, তেমনি নেই এর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ও শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ। ফলে কালের বিবর্তনে মণিপুরী সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মণিপুরী ভাষার বর্ণমালা রক্ষায় তার স্বামী সুখময় সিংহের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের ভাষাটি যেন তুলে দেয়া যায়। সেই চিন্তা থেকেই মণিপুরী পল্লীতে মণিপুরী ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলেন।

বৃন্দারাণী সিনহা জানালেন, বিদ্যালয় স্থাপনের মতো কোনো ঘর না থাকায় তার বসতঘরের বারান্দায় এটি পরিচালনা করে আসছেন। এখানে মণিপুরী শিশুরা তাদের মাতৃভাষার বর্ণমালা লিখতে ও পড়তে পারায় মণিপুরী শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূলধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে পারছে বলে মনে করেন বৃন্দারাণী।

মণিপুরী জাতি হিসেবে নিজেকে গর্ব করে মণিপুরী ভাষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থী জেসমিন বিনতে জমসেদ জানান, বাড়িতে বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মণিপুরী ভাষায় কথা বলি। কিন্তু স্কুলে গিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলতে হয়। এতে আমাদের মণিপুরী ভাষা ও তার বর্ণমালা ভুলে যাচ্ছি। স্কুলের পাশাপাশি প্রতি শুক্রবার মণিপুরী ভাষাকেন্দ্রে আমাদের মাতৃভাষার বর্ণমালাটি ভালোভাবে শিখতে পারছি। তাই গর্ব করে বলতে পারি আমি একজন মণিপুরী।

অহনা সিনহা নামে আরেক শিক্ষার্থী জানান, স্কুলে বাংলায় যেগুলো শিখি তা এখানে আমাদের ভাষায় শিখতে পারছি। তবে আমাদের বর্ণমালার বই না থাকায় অনেক কষ্ট হয় পড়াগুলো মনে রাখতে।

মণিপুরী ভাষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থী ও অভিভাবক কনথৌজম শিল্পী বলেন, আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে আমাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করলেও বেশির ভাগেরই নিজস্ব বর্ণমালার সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই। এতে আমাদের সন্তানদের কাছে মণিপুরী ভাষা ও বর্ণমালা হারিয়ে যাচ্ছে। তবে বৃন্দারাণীর স্কুলে মাতৃভাষা পড়তে ও লিখতে পারায় শিশুদের মনে প্রাণ ফিরেছে।

কুঞ্জ রাণী সিনহা নামে আরেক অভিভাবক বলেন, ২০১০ সালে ক্ষমতাসীন সরকার নতুন করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে সেখানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষার লিখিত রূপ থাকার পর সরকারিভাবে কোনো বই প্রদান করা হয়নি। যার কারণে বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে বেশি দামে মণিপুরী ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

মণিপুরী বর্ণমালা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জুমের আলী। তিনি বলেন, মণিপুরী শিক্ষার্থী বেশির ভাগেরই নিজস্ব বর্ণমালার সঙ্গে কোনো পরিচয় নেই কিন্তু সেই সুযোগ সীমিত। তবে বৃন্দারাণীর স্কুল সীমিত সুযোগের মধ্যে আমাদের শিক্ষার্থীদের মণিপুরী ভাষায় আলোকিত করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি করেন তিনি।

মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, মো. সামসুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, বৃন্দারাণী নিজ উদ্যোগে মণিপুরী শিক্ষার্থীদের তাদের মাতৃভাষায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করছেন। যা পরবর্তী সময়ে তাদের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারবে। সরকার ৫টি ভাষায় শিশুদের জন্য বর্ণমালাসংবলিত মাতৃভাষায় পাঠ্যবই প্রণয়ন ও বিতরণ করে। সেখানে মণিপুরী ভাষা উপেক্ষিত। শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো ভাষাকে পেছনে ফেলে মানসম্পন্ন শিক্ষার অগ্রগতি সম্ভব নয় বলে মনে করছেন শিক্ষানুরাগীরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App