×

জাতীয়

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮:৩৩ এএম

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন চ্যালেঞ্জ

ফাইল ছবি

বায়ুদূষণে বাড়ছে রোগব্যাধি কমছে গড় আয়ু হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য

দেশে বায়ুদূষণ যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। ‘ঢাকার বায়ুমান বিপজ্জনক পর্যায়ে’ কিংবা ‘বায়ুদূষণের শীর্ষে ঢাকা’- কিছুদিন পরপরই এমন তথ্য উঠে আসছে বিভিন্ন গবেষণায়।

বিশ্বের বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজুয়ালের তথ্য অনুযায়ী গত জানুয়ারি মাসের বেশ কয়েক দিন ঢাকা দূষিত নগরীর এক নম্বরে অবস্থান করেছে। জানুয়ারির প্রথম ২৪ দিনের মধ্যে ২৩ দিন ঢাকার বায়ুমান ছিল বিপজ্জনক পর্যায়ে। এর ফলে মানুষের মাঝে বাড়ছে নানা রোগব্যাধি, কমছে গড় আয়ু, পঙ্গুত্বও দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় তার অধিকাংশই বায়ুদূষণজনিত। বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন শ্বাসের মাধ্যমে দূষিত বায়ু নিচ্ছে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, বায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগে বছরে ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। তাদের বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের। এদিকে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর আর রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমেছে ৮ বছর করে। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সরকারের মধ্যেও উদ্বেগ রয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বায়ুুদূষণ রোধে হাইকোর্ট ১২ দফা নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝে প্রশ্ন রয়েছে।

বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের দাবিতে গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলন করেছে পরিবেশবাদী সংগঠন ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), জনউদ্যোগ, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন, আইইডি, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম ও ঢাবি পরিবেশ সংসদ। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় স্বাধীনতা হলে আয়োজিত ‘ঢাকার বিপজ্জনক বায়ুদূষণ রোধে করণীয়’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, আমরা শুধু লক্ষ্য করছি বায়ুুমান ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। এর মধ্যে আরেক ধরনের বাস্তবতার

উদ্ভব হয়েছে। বায়ু দূষণের প্রসঙ্গ তোলা হলে একদল সরকারসমর্থক মনে করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার পথ তৈরি করা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারবিরোধী আরেক দল এটাকে সরকারের ব্যর্থতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায়। এই দুপক্ষের কারো সঙ্গেই আমরা একমত নই। উন্নয়ন কাজ চলাকালে দূষণ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তবে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করেই সব ধরনের দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বড় শহরগুলোতে দূষণ রোধ করতে হলে সবুজায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি ইটভাটার আশপাশের এলাকাগুলোতে যদি গ্রিনবেল্ট করা হতো তাহলে ভাটার দূষণ থেকে আমরা কিছুটা নিরাপদ থাকতে পারব। তবে আমাদের দেশে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সবুজায়ন করার থেকে ধ্বংসের প্রতি প্রবণতা বেশি। শহরের বায়ুকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য যে গ্রিনবেল্ট করা প্রয়োজন এমন কোনো পরিকল্পনাই আমাদের নেই।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বায়ুদূষণ শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বায়ুদূষণ বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। ফুসফুস ও কিডনির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে বায়ুদূষণ। এছাড়া রক্তচাপ, প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি, চোখের সমস্যা, ক্যান্সার ও হৃদরোগেরও অন্যতম কারণ হতে পারে বায়দূষণ। পাশাপাশি বাড়ছে মনের রোগও। বেশি বাড়ছে রাগ, ক্ষোভ, হঠাৎ বিগড়ে যাওয়া, খিটমিটে মেজাজ ও বিষণ্নতা।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই দূষণের শিকার দরিদ্র নারী, শিশুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাদের অধিকাংশই দূষিত এলাকায় বসবাস করেন। যেখানে সিসা দূষণেরও ঝুঁকি আছে। ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে ও স্নায়বিক ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া গর্ভবতী নারীদের শারীরিক ক্ষতি এবং দূষিত এলাকায় বসবাসের ফলে গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয় বায়ুদূষণ। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা বায়ু দূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের যোগসূত্রতারও প্রমাণ পেয়েছেন।

বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক জরিপে দেখা গেছে, প্রজনন স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে বায়ুদূষণ। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত, বায়ুদূষণে পুরুষের শুক্রাণু তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটছে। এমনকি শুক্রাণুর মানও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে নারীদের ডিম্বাণু কল্পনাতীতভাবে কমে গেছে। আবার যেসব ডিম্বাণু আছে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, মেডিকেল বর্জ্য ও রাস্তার ধারে আবর্জনা পোড়ানোর ফলেও বায়ুদূষণ বাড়ছে। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর বড় একটি অংশ পোড়ানো হয়। যার ফলে বায়ু দূষণের মাত্রা অন্তত ৮০ শতাংশ বেড়ে যায়। তারা বলছেন, বর্জ্য পোড়ানোর কারণে ডাইঅক্সিন, ফুরান, মার্কারি, পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইলসহ নানা ধরনের বিষাক্ত উপাদান বাতাসে যুক্ত হচ্ছে। কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইডসহ অন্তত ৬টি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। যার প্রভাব সরাসরি বায়ুমণ্ডলে পড়ে। ঢাকার একটি এলাকায় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পাওয়া যায় ৪৬০ মাইক্রোগ্রাম। দৈনিক ৬৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সহনীয়।

রাস্তা বর্তমানে বায়ু দূষণের প্রধান উৎস বলে মন্তব্য করেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেন, রাস্তায় বেশির ভাগ সময় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হয়। ঢাকা শহরের রাস্তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খোড়াখুড়ির মধ্যে থাকে। আর এর থেকেই পরিবেশে ধুলাবালি বেশি ছড়ায়। এর থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে সাধারণ এবং সহজ সমাধান হচ্ছে পানি ছিটানো। সাধারণত শীতকালে বায়ু দূষণের মাত্রা কিছুটা বেশি থাকে। কারণ সে সময় বায়ু শুষ্ক থাকে এবং ধুলাবালি বেশি থাকে। আর রাস্তা খোড়াখুড়ির মাধ্যমে এ দূষণ ছড়াচ্ছে। যেহেতু ডিসেম্বর, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি এই ৩ মাস বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি থাকে তাই সরকারের উচিত প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা করা। যাতে করে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কিছুটা কমে।

শ্যামলীতে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার ভোরের কাগজকে বলেন, বায়ু দূষণের ফলে বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি বেড়ে যায়। তখন মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে তা ফুসফুসে টেনে নেয়। দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে ফুসফুসে সমস্যা বাড়তে থাকে। শ্বাসকষ্ট বাড়ে। ফুসফুসের প্রদাহের ফলে ফুসফুসের ক্যান্সার হয়। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হলে অক্সিজেন চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে রক্তের সরবরাহও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে হার্টের সমস্যা হয়। হার্ট ও রক্তচলাচলে সমস্যা থেকে মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে। শীতকালে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এ সময় মানুষের মাঝে অ্যাজমা ও এলার্জি বেড়ে যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App