×

মুক্তচিন্তা

শিক্ষা পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন প্রসঙ্গে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:১৭ এএম

শিক্ষা পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন প্রসঙ্গে

১৯৭২ থেকে ২০২৩ সালের আগ পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়েছে কয়েকবার, কিন্তু প্রতিবারই কিছুদিন পর এটি পরিবর্তিত হয়েছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও অধিক সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও একটি দেশের শিক্ষা পদ্ধতি কী হবে তা ঠিক করতে না পারার বিষয়টি খুবই হতাশাজনক। প্রকৃতপক্ষে দেশের প্রথম শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য সুপারিশমালা প্রণয়ন করেন ড. কুদরাত-ই-খুদা। মূলত দেশের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উপযোগী সমাজ গঠনমূলক একটি সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই গঠিত ‘জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ই এদেশের ইতিহাসে প্রথম শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। এই কমিশনের প্রধান ছিলেন ড. কুদরাত-ই-খুদা। ড. কুদরাত-ই-খুদার পর ১৯৯৭ সালে শামসুল হককে নিয়ে শিক্ষা কমিশন করা হয়। তারপর অধ্যাপক কবির চৌধুুরীকে নিয়ে ২০০৯ সালে আরো একটি শিক্ষা কমিশন করা হয়। এর বাইরে আরো কয়েকটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল। উপরোক্ত কমিশনগুলো জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০০কে হালনাগাদ করে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যা শিক্ষা কমিশন-২০১০ নামে পরিচিত। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায় ধরা হয়েছিল। এছাড়া নবম ও দশম শ্রেণিকে মাধ্যমিক এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিকে উচ্চ মাধ্যমিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এ শিক্ষানীতিতে এতদিন পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতিতেই লেখাপড়া চলছিল। কিন্তু ২০২২ সালে এই শিক্ষানীতির আবারো ব্যবচ্ছেদ করা হলো এবং বর্তমানে অর্থাৎ ২০২৩ সাল থেকে তা শুরু হলো। এই শিক্ষা পদ্ধতিতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন ও পাঠক্রমে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, শুধু বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে মূল্যায়ন হবে। কিন্তু পরবর্তী শ্রেণিগুলোতে মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও শিখন কার্যক্রম উভয় থাকছে। নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বই পড়বে। একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগে নিয়ে পড়তে পারবে। অর্থাৎ আগের শিক্ষা পদ্ধতিতে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে পারত বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে এইচএসসি পর্যায়ে বিভাগ নিয়ে পড়বে। তাছাড়া ২০২২ সালের শিক্ষা পদ্ধতি নিম্নলিখিতভাবে ক্রমান্বয়ে চালু হবে- ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত, যা এ বছর শুরু হলো। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি চালু হবে। এখন প্রশ্ন হলো বিগত কিছুদিন আগেও সৃজনশীল পদ্ধতির লেখাপড়াকে বিশ্বের সবচেয়ে যুগোপযোগী লেখাপড়া বলে সেই পদ্ধতি এদেশে চালু করা হয়েছিল। কয়েক বছর যেতে না যেতেই সে পদ্ধতি কীভাবে এদেশে আবার মূল্যহীন হলো? কেনইবা ওই পদ্ধতির পেছনে রাষ্ট্রের হাজার হাজার, কোটি টাকা খরচ করা হলো? তাহলে কী আমরা ধরে নেব কোনো শিক্ষা পদ্ধতি এদেশের চালুর আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষ তা ভালো করে গবেষণা করে দেখেন না? নাকি বাইরের দেশে কোনো একটা শিক্ষা পদ্ধতি দেখার পর তা কোনো বাছবিচার না করেই বাংলাদেশে নিয়ে এসো তা চালু করে দেন? তা না হলে একটা দেশের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে এত বদলাবদলি কেন? বারবার কেনোইবা আমাদের দেশে নতুন নতুন শিক্ষা পদ্ধতি চালুর জন্য আমরা ওঠেপড়ে লেগে যাই? প্রকৃতপক্ষে কোনো একটি দেশে একটি নতুন শিক্ষা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর সে পদ্ধতিতে ছাত্র-শিক্ষকদের অভ্যস্ত হতে কিংবা ওই শিক্ষা পদ্ধতিটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং জনগণকে শিখে উঠতে অনেক সময় চলে যায়। তারপর ওই শিক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে যখন আরেকটি শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয় তখনো তাতে সবার অভ্যস্ত হতে আরো বেশকিছু সময় চলে যায়। এভাবে শিক্ষা পদ্ধতি বারবার নতুন করে শুরু করলে আমাদের প্রজন্ম কোন শিক্ষায় বড় হবে কোন শিক্ষাইবা তাদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাবে তা প্রশ্ন থেকে যায়। শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে মাঝেমধ্যে ঢেলে সাজাতে হয় কিন্তু আমাদের দেশে এত ঘন ঘন শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন আদৌ কি শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো সুফল বয়ে আনছে? নাকি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছাড়া আমরা বারবার এই পরিবর্তন করতেই থাকব? বিষয়টি ভাবা উচিত। কারণ একটা শিক্ষা পদ্ধতি থেকে আরেকটা শিক্ষা পদ্ধতিতে যাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাক্ষেত্রে কতদূর এগিয়ে যাবে তা দৃশ্যমান না হলে নতুন শিক্ষা পদ্ধতিও আগের মতো মুখ থুবড়ে পড়বে। এতে শিক্ষা পদ্ধতি বদলের সুফল শিক্ষার্থীরা পাবে না। আমরা প্রত্যাশা করব শিক্ষাবিষয়ক যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো দেখবেন।

রতন কুমার তুরী : লেখক ও শিক্ষক, ঢাকা। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App