×

মুক্তচিন্তা

ফরগিভ করলেও ফরগেট করবেন না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:১০ এএম

ফরগিভ করলেও ফরগেট করবেন না

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কত, সেটা বলা কঠিন। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যাই প্রায় ৪০টি। এর বাইরেও শ’খানেক দল আছে বলে শোনা যায়। তবে মানুষ কয়েকটি দলের নামই জানে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সব দিক থেকে এগিয়ে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ দলের ইতিহাস, ঐতিহ্য সংক্ষেপে বলার মতো নয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অনেক বড় আন্দোলন-সংগ্রামের পেছনে রয়েছে এ দলের নেতাকর্মীদের অসামান্য ভূমিকা। আওয়ামী লীগের আগে প্রতিষ্ঠিত দলের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি ও মুসলিম লীগের নামোল্লেখ করা যায়। তবে এখন এ দুটি দলের আর তেমন প্রভাব নেই। কমিউনিস্ট পার্টি এক সময় কিছুটা গণভিত্তিসম্পন্ন হয়ে উঠলেও দলটির সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থন তেমন আর নেই। মুসলিম লীগও সেই যে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করল; তারপর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামীও পুরনো দল। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করে দলটি যেভাবে নিন্দিত হয়েছে, তাতে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের টিকে থাকার কথা না থাকলেও দলটি আছে। তাদের কিছু জনসমর্থনও আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগের কিছু তরুণ নেতাকর্মী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠন করে চমক সৃষ্টি করেছিল। অল্প সময়েই জাসদ হয়ে উঠেছিল রাজনীতির দৃশ্যমান শক্তি। অথচ সে সময় প্রত্যাশা ছিল, আওয়ামী লীগের বিপরীতে বামপন্থি দল হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও সিপিবি হবে দেশের অন্যতম প্রধান দল। নানা কারণে তা হয়নি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বড় মাপের নেতা হলেও রাজনীতিতে নানা সময়ে বিতর্কিত ভূমিকা পালনের কারণে তার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও সেভাবে সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর তাই আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল জাসদ। জাসদের সেই রমরমা অবস্থাও এখন আর নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাত্র ক’মাস আগেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল গঠিত হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের দখলে ছিল ২৯২টি। ওই নির্বাচনের সময়ও সম্ভবত কেউ ভাবেনি, দুই বছর যেতে না যেতেই দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি মাত্র দল গঠিত হবে। যদিও বাকশালে আওয়ামী লীগেরই আধিপত্য ছিল, তারপরও কেন আওয়ামী লীগ ভেঙে দিতে হয়েছিল- তার প্রেক্ষাপট বর্ণনায় না গিয়ে বলার কথা এই যে, ব্যবস্থাটি স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে রাজনীতিতে জন্মলাভ করে নতুন একটি রাজনৈতিক সংগঠন- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বিএনপিকে মনে করা হতো জিয়ার রাজনৈতিক হাতিয়ার। জিয়ার মৃত্যু হলে বিএনপিরও অপমৃত্যু হবে, এমনটা অনেকে ভাবলেও বাস্তবে তা না হয়ে উল্টোটা হয়েছে। বিএনপি এখন রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোন দল বড় বা বেশি জনপ্রিয়, তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক পাল্লায় মাপা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ভাবা হয়েছিল, এদেশে আর সামরিক শাসন আসবে না। এ ভাবনাটাও সঠিক ছিল না। দু-দুটি সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। প্রথম সামরিক শাসনজাত রাজনৈতিক দল বিএনপি। আর সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জন্ম দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি এক সময় ক্ষমতায় থাকলেও এর জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তুলনায় কম। তবে জাতীয় পার্টিও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে গুরুত্ব ও আলোচনার বাইরে নেই। আজকের আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখতে চাই আওয়ামী লীগের ওপর। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। এর নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা। এ দলের নেতৃত্বেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। আমরা জানি, একটি রাজনৈতিক দল পরিচালিত হয় ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের মাধ্যমে। ঘোষণাপত্রে থাকে দলের নীতি-আদর্শের কথা। দলটি কী করতে চায়, তার রাষ্ট্র পরিকল্পনার যাবতীয় তথ্যাদি ঘোষণাপত্রে লেখা থাকে। আর গঠনতন্ত্র হলো দল পরিচালনা, নেতৃত্ব নির্বাচনের পদ্ধতি সম্পর্কে লিখিত দলিল। কী কী অপরাধে কাউকে দল থেকে বহিষ্কার বা নেতৃত্ব থেকে অপসারণ করা হবে, তার উল্লেখ থাকে গঠনতন্ত্রে। গঠনতন্ত্রকে দলের শৃঙ্খলা রক্ষার দলিল বলা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ কি সব সময় গঠনতন্ত্র কঠোরভাবে মেনে চলার নীতি অনুসরণ করে? মনে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট পার্টি কিংবা জামায়াতে ইসলামীর মতো ক্যাডারভিত্তিক দল নয়। এ দলে নানা চিন্তার মানুষের সমাবেশ আছে। কেউ হয়তো বাম ধারার প্রতি একটু বেশি অনুরাগী, আবার কারো রয়েছে ডানপ্রীতি। তবে মধ্যপস্থার চিন্তাস্রোতই আওয়ামী লীগের মূলধারা। এ দলে ব্যক্তি পর্যায়ে কোন্দল, রেষারেষিও আছে। ফলে দলের মধ্যে মাঝে মাঝে বিভেদ তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু মোটা দাগে কিছু নিয়মনীতি সবাইকেই মেনে চলতে হয়। নইলে দলে শৃঙ্খলা থাকে না, ঐক্য বিনষ্ট হয়। দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত মেনে চলা দলের নেতা-কর্মী-সদস্যদের জন্য বাধ্যতামূলক। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সবার মতামত নেয়াটাও গণতন্ত্রসম্মত। সবাই মিলে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তা মেনে চলা দলের সবার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের নানা সময়ে নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। অনেকে দলের নীতির বিরোধিতা করেও দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। আবার কেউ অন্য কারণে বহিষ্কৃত হয়েছেন। মিজানুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, কোরবান আলীর মতো নেতাও দলত্যাগী হয়েছেন। পাল্টা আওয়ামী লীগও দু-একজন গঠন করেছেন। আবার দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগে ফিরেও এসেছেন। ড. কামাল হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন- তিনিও আওয়ামী লীগ ছেড়েছেন। এতে আওয়ামী লীগের লাভ হয়েছে না ক্ষতি, তা হিসাব না করেও বলা যায়, গ্রহণ-বর্জনের ধারা অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের মতো আওয়ামী লীগেও বহমান। এ কথাগুলো বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের একটি সাম্প্রতিক দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে। ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সভায় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া নেতাকর্মীদের সাধারণ ক্ষমার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকজন ক্ষমা পেয়েছেন। গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান, বরিশালের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ ও কাটাখালীর বহিষ্কৃত মেয়র আব্বাস আলী সাধারণ ক্ষমার সুযোগে দলে ফিরে এসেছেন। এরা সবাই একই কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত হননি। জাহাঙ্গীর আলম বহিষ্কৃত হন বঙ্গবন্ধু ও গাজীপুর জেলার কয়েকজন নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করে। মুরাদ হাসান বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ফোনে এক অভিনেত্রীর প্রতি অশালীন ও অবমাননাকর কথাবার্তা বলে। আব্বাস আলীকে বহিষ্কার করা হয় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেয়ায়। আওয়ামী লীগ কেন এ অপরাধগুলোকে হঠাৎ ক্ষমার যোগ্য বিবেচনা করল, সেটা জানা নেই। তবে এ ক্ষমা পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে যদি কেউ একই ধরনের আপত্তিকর বক্তব্য রাখে বা মন্তব্য করে, তাকে বিরত করা আর যাবে কি? বঙ্গবন্ধু নিয়ে কিংবা কোনো নারীকে উদ্দেশ করে কটূক্তি করা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে থাকা কারো পক্ষে কি চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ নয়? দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা বেশি ঘটেছে বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায়। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। এতে বিপুল সংখ্যায় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। গঠনতন্ত্র মোতাবেক এদের সবাই সাময়িক বহিষ্কার হন। এমন বহিষ্কৃত নেতার সংখ্যা কয়েকশ বলে আলোচনা আছে। একটা হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিতসহ নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন ৩০৪ জন। তারা মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৫ জন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা কিংবা সমর্থন দেয়ার অভিযোগ ছিল। ১৩৬ জন নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। তথ্যগুলো মনে রাখা দরকার। আগামী জাতীয় নির্বাচন ও বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলার লক্ষ্যেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু বহিষ্কৃতদের ফিরিয়ে নেয়ায় দলের শক্তি বাড়বে, না নতুন করে কোন্দল তৈরি হবে- সেটা দেখার বিষয়। আরেকটি বিষয়ে কঠোর নজর রাখতে হবে। যাদের দলে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে, তাদের একটা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেন দলের পদ-পদবি ফিরিয়ে দেয়া হয়। নইলে দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েও ক্ষমা পাওয়ার নজির যেহেতু বারবার তৈরি করা হচ্ছে, সেহেতু আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঢেউ উঠবে না- সে নিশ্চয়তা কে দেবে? একটা কথা আছে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখতে চাই। এক-এগারোর সময় তাকে মাইনাস করার যে ষড়যন্ত্র হচ্ছিল, তা তিনি সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। ঝঞঅজ-কে তিনি জঅঞঝ-এ পরিণত করেন। তখন তার বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ফরগিভ করব, ফরগেট করব না’। এ নীতি যেন তিনি এখনো অনুসরণ করেন। ক্ষমা করলেও অপরাধ ভুলে যাওয়া চলবে না।

মোনায়েম সরকার : কলাম লেখক, মহাপরিচালক; বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App