×

জাতীয়

আইএমএফের ঋণে কাটবে যেসব সংকট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:০২ এএম

আইএমএফের ঋণে কাটবে যেসব সংকট

ফাইল ছবি

বাজার স্থিতিশীল হবে

রিজার্ভ শক্তিশালী হবে

শর্ত পরিপালনে জোর দেয়ার পরামর্শ

বাংলাদেশের চলমান অর্থনেতিক সংকট মোকাবিলায় বেশকিছু শর্ত দিয়ে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। চলতি ফেব্রয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে সংস্থাটির কাছ থেকে প্রথম কিস্তি হিসেবে বাংলাদেশ পাবে ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বাকি ঋণ আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে ৬ কিস্তিতে পরিশোধ করবে আইএমএফ। ২ দশমিক ২ শতাংশ সুদে নেয়া হচ্ছে এই ঋণ। নানামুখী বৈশ্বিক সংকটের কারণে ডলার নিয়ে যখন বিশ্বব্যাপী হাহাকার চলছে তখন আইএমএফের বড় অঙ্কের ঋণে বাংলাদেশের রিজার্ভ আরো শক্তিশালী হবে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

অর্থনীতিবিদদের মতে, আইএমএফের ঋণে বাংলাদেশের বাজার স্থিতিশীল হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হবে। তবে ঋণের সবগুলো কিস্তি পেতে আইএমএফের দেয়া শর্তগুলো পরিপালনে সরকারকে জোর দিতে হবে।

জরুরিভিত্তিতে লেনদেনে ভারসাম্য রক্ষা ও বাজেট সহায়তার জন্য অর্থ চেয়ে গত বছরের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) চিঠি দেয় বাংলাদেশ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করার অনুরোধ জানায়। এই প্রেক্ষাপটে ঋণ চুক্তি নিয়ে বিশদ আলোচনার জন্য রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল গত বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা সফর করে। এরপর এ বছরের ১৪ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করেন আইএমএফের ভাইস প্রেসিডেন্ট আন্তোয়নেট মনসিও সায়েহ। সফরকালে তিনি যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি দেখেছিলেন তার প্রশংসা করে আন্তোয়নেট বলেন, এটি সারা বিশ্বে একটি ছাপ ফেলেছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অভিনন্দন জানান তিনি।

এরপর গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি অনুমোদন দেয়া হয়। ওই বোর্ড মিটিংয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা এবং আইএমএফ কর্তৃক শর্ত পরিপালনের বিষয়গুলো তুলে ধরেন সংস্থাটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আন্তোয়নেট মনসিও সায়েহ। এর পরই বোর্ড মিটিংয়ে অন্যান্য সদস্যরা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রস্তাবের অনুমোদন দেন।

আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় করা হবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ। এছাড়া আইএমএফর নবগঠিত রেজিলিয়েন্স এন্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় বাংলাদেশ পাবে ১৪০ কোটি ডলার। বাংলাদেশই প্রথম এশীয় দেশ, যেটি এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে।

ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ বলেছে, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন রাখা, দুর্বলকে সুরক্ষিত করা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশ সম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে এই ঋণ। তবে সাফল্য পেতে উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরো বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে।

আইএমএফের ঋণ মঞ্জুরির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেছেন, ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণের সুবাদে দুর্বল হয়ে পড়া রিজার্ভের বিপরীতে বিদেশি মুদ্রার একটি ‘বাফার’ তৈরির সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। এ ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে প্রমাণ হল আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাসমূহ শক্ত ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে আছে এবং অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় অঙ্কের ডলার আসার সুযোগে শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তান হওয়ার আশঙ্কা নেই বাংলাদেশের। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আইএমএফের একটি ঋণ প্যাকেজের অনুমোদন বাংলাদেশের বাজারকে স্থিতিশীল করবে। এতে আমরা কিছু তহবিল পাব, যা আমাদের রিজার্ভ বাড়াবে। এটিই এ মুহূর্তের সেরা কৌশল হওয়া উচিত। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে রিজার্ভ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক সংকটের কারণে ডলার সংকট বাড়ছে। এ অবস্থায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সংস্থাটির এই ঋণ দেয়ার ফলে চাপে থাকা অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। তবে আগামী কিস্তিগুলো পেতে আইএমএফের দেয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো কার্যকর করতে হবে। অন্যথায় তারা ঋণ দেবে না। এজন্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমাতে হবে এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি যাতে না কমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফর এই ঋণ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি সরকারের গৃহীত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। এছাড়া রাজস্ব খাত সংস্কার করলে সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বাড়াতে হবে। ঋণের যথাযথ ব্যবহারের জন্য নীতি ও রাজস্ব প্রশাসনে সংস্কার করতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসন ব্যবস্থা উন্নত হবে।

আইএমএফের আরেকটি শর্ত ছিল বছরে চার বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা, কিন্তু বাংলাদেশ তিনবার মুদ্রানীতি ঘোষণায় সম্মত হয়। তারই অংশ হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকারও এক বিলিয়ন ডলার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর বাইরে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বরাদ্দ থেকে সরকারি কর্মচারীদের সঞ্চয়পত্র এবং পেনশনের সুদের বরাদ্দ আলাদা করার শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। আগামী অর্থবছরে এটি বাস্তবায়ন করতে পারে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রথম কিস্তির আগে আইএমএফের শর্ত পূরণে সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে পরবর্তী ৬ কিস্তির বেলায় প্রতিটি কিস্তির আগে সরকারের কী কী শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে আইএমএফ। প্রথম কিস্তির ঋণ পাওয়ার পরই সরকার রাজস্ব ও জ্বালানি খাত সংস্কার কার্যক্রম শুরু করবে। সংস্কার ঠিকঠাক হলে সক্ষমতা বাড়বে সরকারের। দ্বিতীয় কিস্তি থেকে প্রতিটি কিস্তি পাওয়ার আগে, আইএমএফ মিশন ওই শর্তগুলোর বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করতে এবং সংস্থার বোর্ডের কাছে উপস্থাপন করতে বাংলাদেশ সফর করবে। বোর্ড বাস্তবায়নে সন্তুষ্ট হলেই আইএমএফ ঋণ প্যাকেজের পরবর্তী কিস্তি প্রকাশ করবে।

জানা গেছে, ঋণ পাওয়ার আগেই সংস্কারের কাজ শুরু করেছে সরকার। বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতি ঠিক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আয়কর আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন এবং আদায়ের অযোগ্য খেলাপি ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করার কাজও চলছে। খেলাপি ঋণ প্রকৃতপক্ষে কমানোটাই সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। আর জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে। সূত্র জানায়, ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার সময় হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর মাস, যার পরের মাসেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই নির্বাচনের আগ মুহূর্তের যাতে কিস্তি আটকে না যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকবে সরকার। এজন্য শর্ত পূরণেও কোনো গাফিলতি থাকবে না।

এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, আইএমএফের ঋণে সরকারের একটা বাড়তি লাভও আছে। সেটা হচ্ছে এখন অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও ঋণ দিতে চাইবে। অথচ দরকার হচ্ছে বেশি ঋণের পরিবর্তে বরং অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সুসংহত করা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, সংকট যতটা গভীর, আইএমএফের এ ঋণ তার সমাধান পুরোপুরি দিতে না পারলেও সমাধানের পথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারবে। তবে অর্থ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দিতে হবে। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে। আর এতে উৎসাহিত হচ্ছে হুন্ডি। এগুলো বন্ধে সরকার কতটা আন্তরিক, তার ওপর নির্ভর করবে সংকট কত কম সময়ে দূর হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App