×

জাতীয়

ডলারের প্রভাবে বাড়ছে রমজানের পণ্যের দাম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:৪৫ এএম

ডলারের প্রভাবে বাড়ছে রমজানের পণ্যের দাম

ফাইল ছবি

ডলারের প্রভাবে বাড়ছে রমজানের পণ্যের দাম

ফাইল ছবি

আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় পণ্য খালাস বন্ধ

ডলার সংকট কাটাতে ও রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নিয়েছে সরকার। আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির ফলে কমতে শুরু করেছে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ। সেই হিসেবে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের ওপর চাপ কমার কথা। কিন্তু কাঙিক্ষত স্বাভাবিক অবস্থায় আসেনি ডলারের বাজার। বরং, আগের চেয়ে আরো খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে।

এদিকে, আগামী মার্চের শেষ সপ্তাহে রোজা শুরু হতে পারে। এজন্য গত ডিসেম্বর থেকেই রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি খোলা শুরু হয়েছে। তবে ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানি বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছে আর এলসি খোলায়ও জটিলতা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হু হু করে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। রমজানের প্রায় দুই মাস বাকি থাকলেও এখন থেকেই প্রতিটি পণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। এদিকে, রমজান মাসে পণ্য আমদানির এলসি খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এছাড়া রেমিট্যান্স ও এক্সপোর্ট প্রসিডের ডলারের একটা অংশ যেন ছোলা, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও খেজুরের মতো পণ্য আমদানিতে খরচ করা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সে নির্দেশনাও দিয়েছেন গভর্নর।

তথ্য অনুযায়ী, রমজান মাসের ছয়টি আমদানি পণ্য হচ্ছে ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি – এই দুই মাস এবং তারপর রোজার এক মাসের চাহিদা অনুযায়ী ওই ছয়টি পণ্য আমদানিতে ১৫৩ কোটি মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হয়। আর শুধু রোজার এক মাসের চাহিদা পূরণে এসব পণ্য আমদানিতে প্রয়োজন ৫৬ কোটি মার্কিন ডলার। আমদানি সংকটে গত ১০ মাসে দফায় দফায় নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে খেজুর, চিনি, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, বেসন, মুড়ি, ছোলাসহ বিভিন্ন পণ্যের দামও বেড়েছে। এতে প্রায় প্রতিটি পণ্যই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

সরজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মালিবাগ, খিলগাও, রামপুরা কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, কালমি মরিয়ম খেজুর প্রতি কেজি ৮০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের রমজান মাসে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া, মাবরুম খেজুর ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০০ টাকা, আজোয়া খেজুর ১৫০ টাকা বেড়ে ৮৫০ টাকা, সৌদি মরিয়ম খেজুর ২০০ টাকা বেড়ে ৯০০ টাকা, মেডজুল খেজুর ২০০ বেড়ে ১২০০ টাকা, বরই খেজুর ২০০ টাকা বেড়ে ৪০০ টাকা, বারারি ৬০০ থেকে বেড়ে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

অন্যদিকে, দেশি মুড়ি খোলা ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, গত বছর প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা ছিল। প্যাকেট আল্ট্রা জেষ্টা মুড়ি ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে ১০০ টাকা কেজি ছিল। এসব মুড়ি ৩০ থেকে ৪০ টাকা দাম বেড়েছে। এছাড়া, দোকানে চিনির কেজি ৬০ টাকা থেকে দ্বিগুণ বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোলা প্রতি কেজি ৩০ টাকা বেড়ে ৯০ টাকা, বুটের বেসন ৯০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে ১২০ টাকা, অ্যাঙ্কর বেসন ৭০ থেকে ১০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা, দেশি আদা প্রতি কেজি ১০০ টাকা বেড়ে ১৬০ টাকা, আমদানি করা আদা ১২০ টাকা বেড়ে ২০০ টাকা, চায়না রসুন বেড়ে ২০০ টাকা, আমদানি করা মসুর ডাল (বড় দানা) প্রতি কেজি ২৫ টাকা বেড়ে ১০৫ টাকা, দেশি মসুর ডাল (ছোট দানা) প্রতি কেজি ২০-৩০ টাকা বেড়ে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, অ্যাঙ্কর ডাল প্রতি কেজি ১০/১৫ টাকা বেড়ে ৭০ থেকে ৮০ টাকা, ২ কেজি ওজনের আটার প্যাকেট ১৩৫ টাকা, ২ কেজি ওজনের ময়দা ১৫০ টাকা, ভোজ্যতেল প্রতি লিটার ১৮৫ টাকা, প্রতি কেজি জিরা ৮০০ টাকা, লবঙ্গ প্রতি কেজি ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সোহেল আরমান বলেন, প্রতি বছর রমজান মাস এলেই শুরু হয় বাজার দর নিয়ে অস্থিরতা। তবে রমজান মাসের ২ মাস বাকি থাকলেও প্রতিটি পণ্যের মূল্য গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ফলে আমার মতো সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে মহাবিপদে আছি। প্রায় একই রকম ক্ষোভ ঝাড়লেন বাজার করতে আসা পোশাক শ্রমিক তানিয়া আক্তার। তিনি বলেন, রমজানের দুই মাস আগেই যদি বাজারের এ অবস্থা হয়। রমজান এলে কী হবে! কোনো মাসে খেজুর তেমন না লাগলেও রমজানে খেজুর লাগবেই। যে খেজুর গত বছর ৫০০ টাকা কেজি কিনেছি, সেই খেজুর আজ ৮০০ টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে।

তানিয়া আরো বলেন, চাল, ডাল, চিনি, আটা, ময়দা, খেজুর, মুড়ি, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়েছে। রমজান মাস শুরু হলে আবার বাড়বে! আমরা কই যাব? মালিবাগ কাঁচা বাজারে দেশ-বিদেশ ফ্রুট স্টোরের মালিক শফিকুল বলেন, প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া করতে হয় ক্রেতাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, রমজান শুরু হলে খেজুরের দাম আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা যথাযথভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি দেশের বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম কমিয়ে আনার। আমরাও চাই মানুষ বাজারে গিয়ে স্বস্তি নিয়ে বাজার করুক।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগের পরেও দেশের বাজারে ডলারের সংকট কাটছে না। সংকট আরো চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ডলারে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় বন্দরে আসা জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। ডলারের অভাবে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি বলেই পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, চাল, সার, ছোলা ভোজ্যতেলসহ জরুরি নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি অগ্রাধিকার খাতভুক্ত এসব পণ্য আমদানি বন্ধ হলে বা কমে গেলে দাম বৃদ্ধি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিল্পের উৎপাদনও বন্ধের উপক্রম হবে। এসব কিছুর প্রভাব পড়বে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর। এমনিতেই আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি থাকায় নাভিশ্বাস নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পরিবারে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খালি চোখে ডলারের সংকট যা দেখছি, বাস্তবে তার চেয়ে আরো গভীরতর। প্রকৃতপক্ষে আমাদের ডলার কী পরিমাণ আছে, ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদার বিপরীতে কী পরিমাণ পাচ্ছে তা নিয়মিত তদারকি দরকার। কী পরিমাণ এলসি আসছে, কোনগুলো আগে খোলা দরকার, কোনগুলো এখন খোলা দরকার নেই- বাংলাদেশ ব্যাংকের সে ব্যাপারে নির্দেশনা প্রয়োজন। এখন আমাদের দরকার অর্থনীতিতে ভারসাম্য রেখে প্রয়োজনের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, সেভাবে এলসি খুলতে দেয়া।

পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট-রেমিট্যান্স ব্যালান্স হলেও পেমেন্টে ব্যালেন্স হচ্ছে না। কারণ, এখন আমাদের অনেক পেমেন্টে বাকি পড়ে আছে। ডলারের সংকটে শুধু ভোগ্য পণ্য নয়, গ্যাস, কয়লাও আমদানি করা যাচ্ছে না। আমদানি কমিয়ে আসলে রপ্তানি বাড়ানো যায় না। এটা ব্যালেন্স করতে হয়।

তিনি বলেন, গত বছর আমরা ১৪ বিলিয়ন ডলার পেয়েছি ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে। তার আগের বছর ছিল এর চেয়েও বেশি, কিন্তু এ বছর নেগেটিভ। তাহলে পরিস্থিতি সামলাবে কীভাবে? বাজারে আমদানি করা পণ্যের ঘাটতি শুরু হয়েছে। গমের দাম বেশি, কারণ, ডলার সংকটে গম আমদানি করা যাচ্ছে না। আমদানি সংকটে চিনির দাম বেশি। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দাম আরো বাড়বে।

সূত্র জানায়, জরুরি নিত্যপণ্য আমদানিতে ইতোমধ্যেই দেশের ১১ প্রতিষ্ঠান ২৬৯ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন ডলার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছে। সম্প্রতি দেয়া চিঠিতে প্রতিষ্ঠানগুলো ডলারের চাহিদার বিস্তারিত তুলে ধরেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠিতে দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ২৪৮ মিলিয়ন ডলার চায়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা করেনি। এতে ১১ সংস্থার ২৬৮ দশমিক ৫৩৮ ডলার পরিশোধ আটকে আছে। এর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানিতে ৩টি বিলে ১২৬ দশমিক ৮১৬ মিলিয়ন এবং কয়লা পরিবহনের জাহাজ ভাড়া পরিশোধে ৫টি বিলে ৪ দশমিক ২৬৩ মিলিয়ন ডলার রয়েছে। সোনালী ব্যাংকের চাহিদার মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরের চাল আমদানিতে ১২ দশমিক ২৫৪ মিলিয়ন ডলার, বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানিতে ২৯ দশমিক ৪৭৩ মিলিয়ন ডলার, সার আমদানিতে বিসিআইসি ৩টি বিলে ২ দশমিক ২৯৩ মিলিয়ন ডলার এবং বিএডিসি ৩টি বিলে ২ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানিতে ৩টি বিলে ১২৬ দশমিক ৮১৬ মিলিয়ন এবং কয়লা পরিবহনের জাহাজ ভাড়া পরিশোধে ৫টি বিলে ৪ দশমিক ২৬৩ মিলিয়ন ডলার, টিসিবির ছোলা আমদানিতে ৩টি বিলে ১ দশমিক ৩৬২ মিলিয়ন ডলার, পিডিবির রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৩টি বিলে ১১ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার, ইস্টার্ন রিফাইনারি ৪ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ৭ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিল। এর বাইরে আরো ৬৫ দশমিক ৯৬৪ মিলিয়ন ডলার ও ২ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিল সোনালী ব্যাংক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App