গত ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের দক্ষিণ ভারতের কন্যাকুমারী থেকে শুরু হয়েছিল ভারত জোড়ো যাত্রা। তিন হাজার ৫৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ১৩৫ দিন পর তা শেষ হল কাশ্মীরে। উপত্যকায় প্রবল তুষারপাতের মধ্যেই সমাপ্তি বক্তব্য রাখলেন রাহুল গান্ধী।
বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে ভারত জো়ড়ো যাত্রার ডাক দিয়েছিল কংগ্রেস। ৭ সেপ্টেম্বর কন্যাকুমারীতে স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তিতে ও প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, তামিল কবি তিরুভাল্লুভারের ছবিতে মালা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন রাহুল। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।
যাত্রা শুরু হওয়ার পর দেশের ১২টি রাজ্য ও দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যায় ভারত জোড়ো। বিভিন্ন রাজ্য থেকে বহু অভিনেতা, লেখক কংগ্রেসের এই পদযাত্রায় যোগ দেন। কংগ্রেসের তরফেও এই পদযাত্রার জন্য আলাদা লোগো, মোবাইল অ্যাপ ও টি-শার্ট বার করা হয়।
কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এ বিষয়ে কংগ্রেসের সমালোচনা করলেও হাত শিবিরের তরফে বলা হয়, এই পদযাত্রার সঙ্গে রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ভারতকে একসূত্রে বাঁধতে যারা চান, তাদের প্রত্যেকেই এই পদযাত্রায় যুক্ত হতে পারেন বলে জানানো হয় দলের পক্ষ থেকে।
দীর্ঘ পদযাত্রায় বিশেষভাবে নজর কেড়েছে রাহুলের ক্রমবর্ধমান দাড়ি ও সাদা টি-শার্ট। প্রবল ঠাণ্ডায় পদযাত্রা যখন উত্তর ভারত দিয়ে যাচ্ছে, তখনও গরম পোশাক না পরে ট্রেডমার্ক হয়ে যাওয়া সাদা টি-শার্টেই দেখা গেছিল রাহুলকে।
পদযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতে, কখনো বা মঞ্চে দাঁড়িয়ে নানা বিষয়ে দেশের বিজেপি সরকার ও আরএসএসকে আক্রমণ করেন রাহুল। দেশে সর্বক্ষণ বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ তুলে দাবি করেন যে, দীর্ঘ যাত্রাপথে তিনি মানুষের মধ্যে শুধু প্রেম-ভালোবাসার ছবিই দেখেছেন।
তামিলনাড়ুতে দাঁড়িয়ে তিনি অভিযোগের সুরে বলেন, বিজেপি ও আরএসএস মনে করে জাতীয় পতাকাটা ওদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ১১ সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ু থেকে কেরলে ঢোকে ভারত জোড়ো যাত্রা। কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম, ছত্তীসগড়ের মুখ্যমন্ত্রী এই পদযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন আগেই। তামিলনাড়ুতে যোগ দেন রাজস্থানের সাবেক উপমু্খ্যমন্ত্রী সচিন পায়লট। একদা বিদ্রোহী এই নেতার দলবদলের গুঞ্জনের মধ্যেই এই যোগদানে নয়া প্রাণসঞ্চার হয় এই যাত্রায়।
৩০ সেপ্টেম্বর কর্নাটকে প্রবেশ করে ভারত জোড়ো। এই রাজ্যেরই মাণ্ড্য থেকে পদযাত্রায় যোগ দেন সোনিয়া গান্ধী। কর্নাটকের মাইসুরুতে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে রাহুল জানান, কোনও কিছুই এই পদযাত্রাকে আটকাতে পারবে না। কর্নাটকেই পদযাত্রায় যোগ দেন দুষ্কৃdkদের হাতে নিহত সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের পরিবার।
১৪ অক্টোবর অন্ধ্রপ্রদেশে প্রবেশ করে এই পদযাত্রা। এই রাজ্যে দাঁড়িয়ে রাহুল বিজেপির সঙ্গে ওয়াইএসআর কংগ্রেস, টিডিপি, জেএসপিকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে আক্রমণ করেন। ২৭ অক্টোবর তেলঙ্গানায় প্রবেশ করে ভারত জোড়ো। এই রাজ্যে পদযাত্রা প্রবেশ করার পর তাতে যোগ দেন প্রয়াত দলিত নেতা রোহিত ভেমুলার মা। যোগ দেন অভিনেত্রী পূজা ভট্টও।
৭ নভেম্বর মহারাষ্ট্রে প্রবেশ করে ভারত জোড়ো যাত্রা। ১৬ নভেম্বর এই মরাঠাভূমেই পদযাত্রায় শামিল হন সমাজকর্মী মেধা পাটকর। ১৮ নভেম্বর যোগ দেন মহাত্মা গান্ধীর পৌত্র তুষার গান্ধী। ১৯ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিনে পদযাত্রায় যোগ দেন বলিউড অভিনেত্রী নাগমা।
২৩ নভেম্বর মধ্যপ্রদেশে পৌঁছয় ভারত জোড়ো। ২৪ নভেম্বর পদযাত্রায় পা মেলান প্রিয়ঙ্কা গান্ধী ও তার স্বামী রবার্ট বঢরা। ৪ ডিসেম্বর কংগ্রেসশাসিত রাজস্থানে প্রবেশ করে এই পদযাত্রা। মরুরাজ্যে এই পদযাত্রায় যোগ দেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। ১৬ ডিসেম্বর এই পদযাত্রার ১০০তম দিবসে জয়পুরের অ্যালবার্ট হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান করেন সঙ্গীতশিল্পী সুনিধি চৌহান।
২১ ডিসেম্বর হরিয়ানায় প্রবেশ করে ভারত জোড়ো। ২৩ ডিসেম্বর এই যাত্রায় যোগ দেন ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি।
বড়দিন ও খ্রিস্টীয় নতুন বছর উপলক্ষে সাময়িক বিরতির পর ২ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশে প্রবেশ করে ভারত জোড়ো যাত্রা। এই রাজ্যে পদযাত্রায় শামিল হন এনসি নেতা তথা জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা।
১০ জানুয়ারি পাঞ্জাবে পৌঁছয় ভারত জোড়ো। পদযাত্রায় হাঁটছিলেন জলন্ধরের কংগ্রেস সাংসদ সন্তোষ সিংহ চৌধুরী। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার। একদিনের জন্য বন্ধ থাকে পদযাত্রা।
পাঞ্জাবে এই পদযাত্রায় শামিল হন প্রয়াত পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালার বাবা ও ঐতিহাসক মৃদুলা মুখোপাধ্যায়। ১৮ জানুয়ারি হিমাচল প্রদেশে প্রবেশ করে ভারত জোড়ো।
১৯ জানুয়ারি অধুনা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়া জেলা থেকে শুরু হয় এই পদযাত্রা। পদযাত্রায় যোগ দেন বলিউড অভিনেত্রী উর্মিলা মাতণ্ডকর।
২৯ জানুয়ারি কাশ্মীরের লাল চকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রাহুল। এনসি সভাপতি ও জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা রাহুলকে আদি শঙ্করাচার্যর সঙ্গে তুলনা করেন। জানান যে শঙ্করাচার্য যেমন কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ‘দিগ্বিজয় যাত্রা’ করেছিলেন, তেমনই রাহুলও দেশকে জুড়তে ভারত জোড়ো যাত্রা করছেন।
এছাড়া, এই পদযাত্রার বিভিন্ন সময় এই পদযাত্রায় শামিল হন অভিনেতা কমল হাসন, রিয়া সেন, লেখক অরুন্ধতী রায় প্রমুখরা। তাদের অনেকেই জানান যে, তারা কংগ্রেসের কেউ না হলেও ভারত জোড়ো যে আদর্শ নিয়ে এগিয়ে চলছে, তাকে সমর্থন করেন।
দিল্লিতে ভারত জোড়ো যাত্রা প্রবেশ করার পর অভিযোগ তোলা হয় যে, রাহুলের নিরাপত্তাবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দেয় কংগ্রেস।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাহুলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিআরপিএফ জানিয়েছে, রাহুলই ১১২ বার নিরাপত্তাবিধি লঙ্ঘন করেছেন। তাদের তরফে কোনো বিচ্যুতি নেই।
কাশ্মীরেও স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রাখার অভিযোগ তোলা হয় কংগ্রেসের তরফে। যাত্রা সাময়িক ভাবে স্থগিতও করে দেওয়া হয়। পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
গুজরাট ও হিমাচলে ভোট থাকা সত্ত্বেও কেন ভোটের আগে রাজ্য দুটির ভেতর দিয়ে পদযাত্রা হলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কংগ্রেস জানায় অল্প সময়ে এতগুলো জায়গায় সম্ভব নয়।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে ২১টি সমমনস্ক দলকে ৩০ জানুয়ারি ভারত জোড়ো পদযাত্রার সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অনুরোধ জানান। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে থাকা দলগুলি এই ডাকে সাড়া দিলেও, ডাক উপেক্ষা করে তৃণমূল, এসপি, বিএসপির মতো দলগুলি। আপকে অবশ্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
সোমবার প্রবল তুষারপাতের মধ্যেই রাহুলের নেতৃত্বে পদযাত্রা পৌঁছয় ‘শের-ই-কাশ্মীর’ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। যাত্রার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয় সেখানেই। গোটা যাত্রাপথেই নানা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। কখনও দেখা যায় রাহুল ও প্রিয়ঙ্কাকে ছোট ভাইবোনের মতোই খুনসুটি করতে। কখনোবা মা সোনিয়া গান্ধীর গলা জড়িয়ে থাকতে দেখা যায় রাহুলকে।
ভারত জোড়ো ভোটবাক্সে কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে দ্বিধায় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দও। তবে অনেকেই মনে করছেন, একের পর এক নির্বাচনে পরাজিত হওয়া কংগ্রেসকে চাঙা করতে এই পদযাত্রার প্রয়োজন ছিল। এই পদযাত্রা নেতা রাহুলের এক অগ্নিপরীক্ষাও ছিল বটে। নেতা হিসেবেও তার উত্তরণ ঘটল কিনা, তা জানতে সবাইকেই আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।