×

মুক্তচিন্তা

সম্প্রীতির পথ ও পাথেয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৩৫ এএম

নেহরু কাপ ক্রিকেট খেলা দেখতে কলকাতায় গিয়েছিলাম। ইডেন গার্ডেনে পাকিস্তান-ভারতের খেলা শেষে ফেরার পথে আমার সফরসঙ্গীর পরিচিত নিউমার্কেটের এক দোকানে বসে চা পান করছিলাম। এমন সময় দুজন ছেলে দোকানে উঁকি দিয়ে দোকানিকে উদ্দেশ করে বলল, ‘নে, আজ তোরা জিতে গেলি, মিষ্টিমুখ করা আমাদের।’ আমি ওদের কথা বুঝতে পারিনি। পরে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলে সে মুখ ভার করে বলেছিল, ‘আজ খেলায় পাকিস্তান জিতেছে, আমরা ভারতীয় মুসলমান, তাই আমাদের উদ্দেশে অমন অপমানজনক উক্তি করে গেল।’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি কি পাকিস্তানের সমর্থক? সে দৃঢ়ভাবে বলল, ‘পাগল নাকি? দেখুন আমার বাড়ি হাওড়ায়। প্রতিদিন বাড়ি থেকেই আসা-যাওয়া করি। এদের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাৎ হয়। নিজ দেশের থেকে অন্য দেশ কখনো আমার প্রিয় দেশ হতে পারে না। আমি পাগল বা অসুস্থ নই যে, নিজ দেশের পরিবর্তে অদেখা-অচেনা অপর কোনো দেশের সমর্থক হব। সংখ্যালঘু মুসলমান হওয়ার কারণে এ ধরনের অপমানজনক কটূক্তি ছোটবেলা থেকেই শুনে শুনে গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওসব আর গায়ে মাখি না।’ আরেকবার গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে মুম্বাই যাচ্ছি। উদ্দেশ্য সেখান থেকে গোয়া যাব। হাওড়া থেকে ট্রেনে আমাদের পাশের সিটের যাত্রী কলকাতার বাঙালি ভোলা ঘোষ আর তার স্ত্রী ওড়িশার মেয়ে গীতা দেবী। তিনি কলকাতার স্থায়ী বাঙালিদের ঢঙে অনর্গল বাংলা বলেন। না বললে জানতাম না তিনি ওড়িয়া। বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেড়াতে আসা নিয়ে কথা শুরু হলেও পরস্পরের ভাষা বাংলা বলেই নানা গল্প-আলাপচারিতার পরিধি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় নানা বিষয় নিয়ে খোশগল্প চলছিল। হঠাৎ গীতার এক প্রশ্নে সব ওলট-পালট হয়ে যায়। গীতা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘দাদা আপনি কি বাঙালি? না মুসলমান?’ প্রশ্নটি শোনামাত্র কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের কথা মনে পড়ে গেল। তার শ্রীকান্ত উপন্যাসে পড়েছিলাম ‘আজ এ পাড়ার বাঙালিদের সঙ্গে ওই পাড়ার মুসলমানদের ফুটবল ম্যাচ।’ আমি গীতার প্রশ্নে অবাক হলেও উত্তরে বলেছিলাম, ‘জাতিতে আমি বাঙালি। সম্প্রদায়ে মুসলমান।’ গীতা আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর শুনে আস্তে করে মুখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না সে যাত্রায় গীতাদের সঙ্গে আলাপ-গল্পের সেখানেই ইতি। বাকি পথে অপরিচিত হয়েই ট্রেন যাত্রা শেষ করেছিলাম। কলকাতার বড়বাজার এবং নিউমার্কেটের পেছনের বিহারি মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকায় থাকার ও খাবার হোটেলগুলোর রমরমা ব্যবসার মূলে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় যারা যায় তাদের মধ্যে ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে তারা বড়বাজারের আশপাশের হোটেলে ওঠে। অন্যরা প্রায় সবাই নিউমার্কেটের পেছনের হোটেলগুলোতে। খাবার হোটেলগুলোর গুরুপাকের গরুর মাংসের নানাপদের রান্নাসহ মগজ, কলিজা, নেহারি ইত্যাদি কম দামের মজাদার খাবারের আকর্ষণে সবাই ছোটে বিহারি মুসলমানদের খাবার হোটেলগুলোতে। এক সকালে তেমন একটি হোটেলে নাস্তা করছি। নাস্তা খেতে বসা বাংলাদেশের মানুষের সংখ্যাই ছিল অধিক। হঠাৎ এক বিহারি মুসলমান আমাদের উদ্দেশ করে আজেবাজে কথা বলায় তুমুল বচসার ঘটনা ঘটে। বিহারি লোকটি আমাদের উদ্দেশে বলেছিল, ‘তোমরা বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে দেশের ডলার লুটাও। দেশপ্রেম, ধর্মপ্রেম বলে কিছু নেই। মুসলিম দেশ পাকিস্তান ভেঙেছ। তোমরা নামে মুসলমান। কর্মে কাফের।’ এই কথা শোনার পর বাংলাদেশের সবাই মিলে বিহারিটিকে ঘিরে ধরে। তীব্র বাদানুবাদে পুলিশ ডাকতে উদ্যত ক’জন। এমন সময় হোটেলের মালিক দৌড়ে আসে। সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করে এবং ওই বিহারিকে সবার কাছে মাফ চাইতে বলে। বিহারিটি উল্টো হোটেল মালিককে বলে, ‘আমি অন্যায় কিছু বলিনি। এরা যা তাই বলেছি। আমিও পাকিস্তানের নাগরিক ছিলাম। পরিবার নিয়ে থাকতাম খুলনার খালিশপুরে। এরা পাকিস্তান ভেঙে আমাদের পাকিস্তানে থাকতে দেয়নি। প্রাণ নিয়ে হিন্দুস্থানে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। ওরা পাকিস্তান ভেঙেছে। ওদের ওপর আল্লাহর গজব পড়বে।’ হোটেলের মালিক আর স্থির না থেকে কিল-থাপ্পড় মেরে গলা ধাক্কা দিয়ে বিহারি লোকটিকে হোটেল থেকে বের করে দিয়েছিল। সন্দেহ নেই বিহারিটি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী ছিল। যুক্ত ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের সঙ্গেও। কৃত অপকর্মের কারণেই স্বাধীনতার পরক্ষণেই এখানে পালিয়ে আসে। খুলনার খালিশপুর-দৌলতপুর থেকে অনেক বিহারি নিকটবর্তী সীমান্তের সুযোগে কৃত অপকীর্তির সাজা এড়াতে ভারতে পালিয়ে এসেছিল। বচসার শুরু থেকে শেষ অবধি সব কথা হিন্দি ভাষায় হয়েছিল। ওই অঞ্চলে বাংলা ভাষায় কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। ১৯৮৬ সালে কলকাতায় গিয়েছিলাম। বিমানে যাচ্ছি জেনে আমার কাছে এক আত্মীয় কিছু খাদ্যদ্রব্য দিয়েছিলেন কলকাতায় তাদের পরিচিত জনৈক দীলিপ সেনের এন্টালি সিআইটি রোডের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। দমদম বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সিতে সোজা বড়বাজার-সংলগ্ন স্টার গেস্ট হাউস নামক হোটেলে উঠি। হোটেলের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রুমে গিয়েই খাদ্যদ্রব্যগুলো পৌঁছে দেয়ার তাগিদ অনুভব করি। বিলম্বের কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সেগুলো নিয়ে ছুটলাম দীলিপ সেনের বাসার খোঁজে। যথাস্থানে পৌঁছে পথচারী একজনকে জিজ্ঞেস করেই পেয়ে গেলাম দীলিপ সেনের বাড়ি। দীলিপ সেন বাসায় ছিলেন না। তার স্ত্রীর কাছে খাদ্যদ্রব্যগুলো এবং একটি চিঠি পৌঁছে দিই। তিনি আমার আত্মীয়ের খোঁজ-খবর জিজ্ঞেস করেন। আমি কোথায় উঠেছি, কদিন থাকব, কী কাজে এসেছি ইত্যাদি প্রশ্নের ফাঁকে চা-নাস্তা এলো। অধিক আন্তরিকতায় দুপুরে খাবার খেতে জোর করলেও যাত্রায় ক্লান্ত, তাই বিশ্রাম নেয়ার কথা বলে অনেক কষ্টে হোটেলে ফিরে আসি। পরদিন সকালে হোটেলের দরজার কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দেখি হোটেলের বোর্ডারদের ফরমায়েশের কাজের বিহারি কিশোরটি। সে জানায় দুজন মহিলা আমাকে খোঁজ করছেন। নিচে অভ্যর্থনা রুমে তারা বসে আছেন। আমাকে নিচে যেতে বলেছেন। ছেলেটির কথা শুনে আমি হতবাক। আমাকে এখানে আবার কোন মহিলা খুঁজতে আসবে। কোথাও ভুল হয়েছে ভেবে নিচে নেমে দেখি সোফায় বসে আছেন দীলিপ সেনের স্ত্রী এবং তার ছোট বোন। যিনি চট্টগ্রামে থাকেন। কলকাতায় বোনের কাছে বেড়াতে এসেছেন। আমাকে দেখামাত্র, ‘এই ছেলে তোমার ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে এক্ষুনি চলো। তোমার হোটেলে থাকা চলবে না। নূরনের ভাসুরের ছেলে তুমি, আমরা থাকতে হোটেলে থাকবে, এটা হবে না।’ অনেক চেষ্টা করেও পার পেলাম না। বাধ্য হয়ে হোটেলের পাট চুকিয়ে তাদের সঙ্গে রওনা হলাম। নূরন চাচির চিঠিতে আমার পরিচয় পেয়ে তারা ছুটে এসেছেন আমাকে নিয়ে যেতে। ১০-১২ দিন অধিক আদর স্নেহে তাদের বাসায় ছিলাম। দীলিপ সেনের আদিনিবাস চট্টগ্রামে। তার স্ত্রীর বাবা চট্টগ্রামের এবং মা ছিলেন বার্মিজ। দীলিপ সেনকে মামা এবং তার স্ত্রীকে মামি সম্বোধন করেছি। আমার নূরন চাচিকে দীলিপ সেন কেবল বোনই ডাকেনি, ভাই ফোঁটার দিন রাখি পরিয়ে ভাই-বোন হয়েছিলেন। সে সম্পর্কের গভীরতা ও দৃঢ়তা আমার প্রতি তাদের ভালোবাসায় অনুভব করেছিলাম। দীলিপ মামার বাসায় থাকাবস্থায় কলকাতার বাঙালিদের জীবনযাপন কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। কাক ডাকা ভোরে চারপাশ থেকে আসা ঠুক-ঠাক শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি রান্নাঘরের পাশে শক্ত পাথরের ওপর বড় কয়লা খণ্ড হাতুড়ির আঘাতে ছোট খণ্ড খণ্ড করার আশপাশের অভিন্ন দৃশ্য। খণ্ডিত কয়লায় উনুন ধরিয়ে নাস্তা তৈরির আয়োজন। অল্পক্ষণ পরই সকালের কলকাতার স্বচ্ছ নীলাকাশ ধোঁয়ায় বিবর্ণ রূপ নেয়। রান্নার কাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কয়লানির্ভর। তবে কলকাতার অনেক বাড়িতে বেসরকারি খাতের পাইপ লাইনে এলপি গ্যাস সংযোগও আছে। তবে সে গ্যাস সার্বক্ষণিক নয়। সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গ্যাস সরবরাহ হয়ে থাকে। বাকি সময় থাকে বন্ধ। কেন্দ্রীয়ভাবে গ্যাস নিয়ন্ত্রিত বলেই একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি বাঁচাতে বা ভেজা কাপড় শুকাতে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে গ্যাস অপচয়ের কোনো সুযোগ তাদের নেই। অবশ্য এলপি গ্যাসের কারণে সে দৃশ্য আজ আর নেই। এখন গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে সিলিন্ডার গ্যাস। সেই জীবনযাপনের ভেতর রয়েছে সকালে নাস্তা সেরে থলে হাতে বাজারে যাওয়া। ১০টা-৫টা অফিস করা। বিকালে চা-নাস্তা খেয়ে জমপেশ আড্ডা দেয়া, তাস খেলা, টিভি দেখা। ছুটির দিনে হাতি বাগানে, রবীন্দ্র সদনে নাটক দেখা। পুরাতন কলকাতার ছবিঘরে গিয়ে বাংলা ছবি দেখা। একত্রে বসে গান শোনা। এক নির্মল পারিবারিক-সামাজিক সৌহার্দপূর্ণ জীবনযাপন। নিম্ন মধ্যবিত্ত এই বাঙালি পরিবারগুলোর বিলাসী-বাড়তি চাহিদা যেমন নেই, একইভাবে নেই অর্থবিত্তের পিছু ছুটোছুটিও। নিজ নিজ অবস্থানে তারা সুখী এবং সন্তুষ্ট। গৃহের ব্যবহার্য আসবাবপত্র-দ্রব্যসামগ্রী সবই সেকেলে-সাবেকি আমলের। বংশপরম্পরায় সেগুলো ব্যবহার করে আসছেন তারা। উত্তরাধিকার সূত্রেই সেগুলো পেয়ে থাকবেন। সেগুলো পাল্টে হাল আমলে পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ-আগ্রহ তাদের মধ্যে দেখিনি। বিপরীতে কলকাতার অবাঙালি মাড়োয়ারি পরিবারগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়বহুল বিলাসী জীবনযাপনও দেখেছি। ঢাকায় ফেরার সময় দীলিপ মামার ছেলে আমাকে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছে পর্যন্ত দিয়েছিলেন। এরপর কলকাতায় গেলে তাদের বাসায় গিয়ে দেখা করতে ভুল করতাম না। দীলিপ মামার স্ত্রী মারা যাওয়ার সংবাদে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। কী নির্মল ভালোবাসায় আমাকে অতি আপন করে নিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রদায়গত ভিন্নতা তাদের চিন্তা, কর্মে ও আচরণে বিন্দুমাত্র অনুভব করিনি। মনে হয়েছে আমি তাদের এবং তারা আমারই অতি নিকটজন। অনাত্মীয়কে খুব সহজে আপন করে নেয়ার অসাধারণত্ব দেখেছি দীলিপ মামার পরিবারে। যা শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে আজীবন। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App