×

মুক্তচিন্তা

জোটবদ্ধতা সন্ত্রাস এবং ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৩৬ এএম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দ্রুত নিকটবর্তী হচ্ছে। ইতোমধ্যে শৈত্যপ্রবাহের তীব্রতাও কিছুটা অনুভূত হয়েছে। এই ঠাণ্ডার মধ্যেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ভিন্ন মাত্রায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে। অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হওয়ার দুটি লক্ষণ হচ্ছে- ১. জনসমর্থনহীন অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দলের জোটবদ্ধতা; এবং ২. গণতন্ত্রে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে নজরদারি প্রসঙ্গ। জনসমর্থনহীন জোটবদ্ধতার সংখ্যাধিক্য অর্থাৎ জনসমর্থনের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কম বা সংখ্যাহীনতা সত্ত্বেও দেখে মনে হতে পারে অনেকগুলো দল জোটে শরিক হচ্ছে। যাদের উপস্থিতি শুধুই সংখ্যাধিক্যতার মধ্যেই সীমিত। এখানে আছে ৪ দলীয় গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যজোট, ১৫ দলীয় সমমনা গণতান্ত্রিক জোট, ১২ দলীয় জোট, এবং ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট (মূলত ১০ দল)। জোটবদ্ধতার এই সমীকরণ মূলত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ডানপন্থি এবং অতি বামপন্থি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের একত্রিত হওয়ার ফলশ্রæতি। এরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে এক হওয়ার দুর্দান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যাহীনতার সংখ্যাধিক্য জোটবদ্ধতার এসব প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জোট করা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ ছিল। এসব জোটের মধ্যে আছে ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তান শাসনামলে এবং স্বাধীনতার পরে সাম্প্রদায়িকতার অনুসারী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও এদের সমর্থিত নামসর্বস্ব দল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ৭৪ শতাংশ ভোটের বিপরীতে বিরোধী ২৬ শতাংশ ভোটারের প্রায় সবাই ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে অতি ডানপন্থি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো যেমন ছিল, তেমনি উগ্রবামপন্থি দলও ছিল। এই শক্তিই একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির ঘাতক হিসেবে বাঙালিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে। আবার এদের মধ্যে অনেক উগ্রবামপন্থি বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বামপন্থার অনুসারী রাজনৈতিক শক্তি বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো সেই বিরোধিতা অব্যাহত রেখেছে। অবশ্য কেউ কেউ আবার ‘আদর্শিক অবস্থানে’ ফিরে এসেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের ঘাতকদের সমর্থক, বেনিফিশিয়ারি যারা, তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও জনসমর্থনের দিক দিয়ে তারা খুব নগণ্য অবস্থাতেই রয়ে যায়। পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার জন্য গ্রেনেড হামলা দ্বারা ২৪ জন নেতাকর্মী হত্যার ঘাতক বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থকগোষ্ঠী উল্লেখিত জোটবদ্ধতার মধ্যে আছে। এসব ঘাতকদের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকরা ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে এক হয়ে শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এভাবে ১৯৭১, ১৯৭৫ এবং ২০০৪-এর ঘাতকরা একই বিএনপির নেতৃত্বে একজোট হওয়ার চেষ্টায় আছে। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে (১৯৭০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত) বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে যাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৬ শতাংশ জনসমর্থনের ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্বের প্রতি একনিষ্ঠ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির বিচ্যুতির সুযোগে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী সেই শক্তি এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই শক্তি নিজেরাও অনুভব করে, তাদের সমর্থন বেশি নেই, তাই একদিকে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানোর পাশাপাশি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করে শান্তিপ্রিয় বাঙালির মনে ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও তারা অতীতে করেছে এবং বর্তমানেও করছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির নামসর্বস্ব অবস্থায় অধিক সংখ্যায় জোটবদ্ধতার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা’। একদম শুরু থেকেই জনসমর্থহীন এই রাজনৈতিক শক্তির আছে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের জানমালের ওপর নির্বিচারে আক্রমণের ইতিহাস। অতীতের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। এই প্রসঙ্গেই আসছে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে গোয়েন্দা নজরদারির প্রসঙ্গ। জাতীয় সংসদে গত ১২ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বন্ধে মূলত ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের (ওএসআইএনটি) মাধ্যমে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর বিষয়টিকে ‘আইনসম্মত’ হিসেবে আখ্যায়িত করার বিরোধিতা করেছেন সাংবাদিক কামাল আহমেদ। এ জন্য তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ১৯৬২ সালের দেয়া একটি সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলা যাবে না’। কামাল আহমেদের এ সংক্রান্ত মতামত একটি জাতীয় দৈনিকে (প্রথম আলো) ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে ‘সরকারবিরোধিতা গণতন্ত্রে বৈধ, আড়িপাতার যুক্তি নয়’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। ‘সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ’ না বলার বিষয়টি বর্তমান সরকার খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে থাকে, যা আমরা বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে দেয়া বক্তব্য, টক শোর আলোচনা এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কলাম থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারি। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স) প্রকাশিত সরকারের সমালোচনাভিত্তিক বিভিন্ন অডিও-ভিডিও প্রকাশের দ্বারা। কামাল আহমেদের এ সংক্রান্ত ‘মতামত’ও এ ক্ষেত্রে জ¦লন্ত উদাহরণ হিসেবে গণ্য করার দাবি রাখে। তবে অবাক করার বিষয়টি এর মধ্যেও আছে, আর তা হচ্ছে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স (ওএসআইএনটি) সম্পর্কে কামাল আহমেদের উপস্থাপনের অসাবধানতা। কামাল আহমেদ যাকে বলছেন ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজি (ওএসআইএনটি)’ আসলে তা ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স (ওএসআইএনটি)’, ‘টেকনোলজি’ শব্দটা এখানে ব্যবহৃত হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেদিন ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স উল্লেখ করে আড়িপাতার বা গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়টিকে আইনসম্মত হিসেবে আখ্যায়িত করে জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার পরদিন অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে বিশ্বখ্যাত দ্য ইকোনমিস্ট-এ ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ইজ পায়ার্সিং দ্য ফগ অব ওয়ার ইন ইউক্রেন, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টস এন্ড স্যাটেলাইট ইমাজেরি প্রোভাইড অ্য টোরেন্ট অব ড্যাটা, বাট ক্যান ওভারহেলম এন্ড কনফিউজ’ অর্থাৎ ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ইউক্রেনে যুদ্ধের কুয়াশা ভেদ করছে, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট এবং স্যাটেলাইট ইমেজ ডেটার প্রবাহ প্রদানের মাধ্যমে, তবে তা আচ্ছন্ন এবং বিভ্রান্ত করতে পারে।’ এই সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়ার মিডলবেরি ইনস্টিটিউটের জেফরি লুইস গুগল মানচিত্রের রোড-ট্রাফিক রিপোর্ট ব্যবহার করে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৩টা ১৫ মিনিটে সীমান্তের রাশিয়ান দিকে অস্বাভাবিক ট্রাফিক জ্যাম শনাক্ত করেছিলেন। এটি দেখে তিনি (জেফরি লুইস) টুইট করেছিলেন ‘সামওয়ান’জ অন দ্য মুভ’। কেউ যেন এগিয়ে যাচ্ছে। এর মাত্র তিন ঘণ্টারও কম সময় পরে ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। দ্য ইকোনমিস্ট প্রায় এক বছর পর প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে জেফরি লুইস কর্তৃক ব্যবহৃত ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স’-এর উদাহরণ তুলে ধরেছেন। কিন্তু রাশিয়া কর্তৃক ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর ৬টার দিকে ইউক্রেন আক্রমণের মাত্র তিন দিন পর ২০২২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারিতেই ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টার র‌্যাচেল লারম্যান ‘অন গুগল ম্যাপস, ট্র্যাকিং দ্য ইনভ্যাশন অব ইউক্রেন, দ্য অ্যাপ হ্যাজ বিকাম অ্যা টুল ফর ভিজুয়ালাইজিং দ্য মিলিটারি অ্যাকশন, হেলপিং রিসার্চার্স ট্র্যাক ট্রুপস এন্ড সিভিলিয়ানস সিক শেলটার’ অর্থাৎ ‘গুগল ম্যাপে, ইউক্রেন আক্রমণ ট্র্যাকিং অ্যাপটি সামরিক ক্রিয়াকলাপ দৃশ্যায়নের একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, আশ্রয় সন্ধানী সৈন্য এবং বেসামরিক ব্যক্তিদের ট্র্যাক করতে এটি গবেষকদের সহায়তা করছে।’ শিরোনামে রিপোর্ট করেছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে সব তথ্যই পাওয়া সম্ভব। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন দুটিকে যদি আমরা ওপেন সোর্স ব্যবহারের নমুনা হিসেবে গ্রহণ করি (এবং প্রকৃত ঘটনাও তাই) তাহলে এটি কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণের আগেই একজন বেসামরিক ব্যক্তি যদি এই আক্রমণটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়ে থাকেন, তাহলে রাষ্ট্র তা করলে সমস্যা বা আপত্তি থাকার কথা নয়। শুধু তাই নয়, ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স গবেষকদের তথ্য-উপাত্তের উৎস হিসেবেও এখন ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সবকিছু মিলিয়ে গণতন্ত্রকে সুরক্ষা তথা জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কবল থেকে সাধারণ মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নিমিত্তে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে এ ধরনের নজরদারির প্রয়োজনীয়তা যুগোপযোগী এবং তাই অনস্বীকার্য। সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন সবার মতামতও তাই। অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App