×

জাতীয়

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:৫০ এএম

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

ফাইল ছবি

শহর ছাড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জেও চলছে গ্যাং কালচার

কোনো কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য। সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে। খুন, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালান, মাদক সেবনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে কিশোর অপরাধীরা। ইভটিজিং ও আধিপত্য নিয়ে বিরোধে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিচ্ছে এরা। কিশোর অপরাধ দমনে জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে নানাভাবে চেষ্টা করেও পেরে উঠছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ডাটাবেজ তৈরির কাজ চললেও মিলছে না সুফল। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে পাড়া-মহল্লা, অলিগলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। মোটরসাইকেল নিয়ে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর কারণে সবার কাছে আতঙ্কের নাম এখন ‘কিশোর গ্যাং’। আগে শহরে এদের বিচরণ থাকলেও এখন দেশের সর্বত্রই এই গ্যাং কালচার ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রাম-গঞ্জেও বিস্তৃত হয়েছে কিশোর অপরাধীদের নেটওয়ার্ক।

বিট পুলিশের মাধ্যমে জনসচেতনা সৃষ্টি এবং সন্তানদের ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতার কাজ চললেও মিলছে না সুফল। জাতীয় জরুরিসেবা ‘৯৯৯’ এবং থানায় কিশোরদের নিয়ে অভিযোগ যাচ্ছে হরহামেশা। পাড়া-মহল্লায় এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রতিকার চাইছেন এমন ঘটনাও কম নয়।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বলেন, সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে অসঙ্গতি ও বৈষম্যের কারণে কিশোর অপরাধের উৎপত্তি হয়। পরে এদের রাজনীতিকীকরণ ও ব্যবহার করা হয় নানা অপরাধে। ক্ষমতার স্পর্শ পেয়ে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ডিআইজি (প্রশাসন) খন্দকার লুৎফুল কবির ভোরের কাগজকে বলেন, হেডকোয়ার্টার্স থেকে সব থানায় কিশোর অপরাধীদের তালিকা করার নির্দেশনার পাশাপাশি তা প্রতিরোধে করণীয় ঠিক করতে নির্দেশনা রয়েছে। স্থানীয় সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে এ ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে। পুরো বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন অপরাধ দমনে সমাজের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ডিআইজি (অপারেশন) হায়দার আলী খান বলেন, কিশোর অপরাধীদের ব্যাপারে পুলিশ সবসময় সতর্ক রয়েছে। হেডকোয়ার্টার্স থেকে তা মনিটর করা হচ্ছে। পুলিশের মাসিক সভায় এ ব্যাপারে আলোচনা হয় নিয়মিত।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিআইজি (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, প্রতিটি থানায় কিশোর অপরাধীদের ডাটাবেজ তৈরির নির্দেশনা রয়েছে, কাজ চলছে। এজন্য আগেই নির্দেশনা দেয়া আছে। বেশকিছু থানা তালিকা প্রস্তুতি করে হেডকোয়ার্টার্সে পাঠিয়েছে। অন্য থানাগুলো তালিকা তৈরির কাজ করছে। তালিকায় যেসব কিশোরদের নাম আসছে বিট পুলিশের মাধ্যমে তাদের অভিভাবকদের কাছে সন্তানকে সংশোধনের চেষ্টার জন্য বার্তা দেয়া হচ্ছে।

নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এই চক্রে বেশি জড়িত জানিয়ে তিনি বলেন, যেখানে বস্তি বা নিম্নআয়ের মানুষের বসবাস বেশি সেখানে কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা বেশি। সেই হিসেবে মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও ওয়াড়িতে কিশোর অপরাধী বেশি। তারা তুচ্ছ ঘটনা থেকে হত্যাকান্ড পর্যন্ত সংঘটিত করছে। সব তুচ্ছ ঘটনা পুলিশের একার পক্ষে মনিটর করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সমাজের সবারই দায়িত্ব রয়েছে। কিশোর অপরাধীদের নিয়মিত প্রক্রিয়ায় আইনের মাধ্যমে সংশোধনাগারে পাঠানো হচ্ছে।

ডিএমপির তথ্য মতে, গত বছর রাজধানীতে খুন হয়েছে ১৬৬ জন। এর মধ্যে ৫৫টি ঘটনা ঘটেছে ভাসমান অপরাধীদের হাতে। তারা খুন, ছিনতাই, মাদক সেবন থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধে জড়িত। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনি করছে তারা। হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চুরি-ডাকাতি-ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে।

পুলিশের সূত্র মতে, রাজধানীতে অপরাধে জড়িতদের অনেকের ঠিকানা মহাখালীর কড়াইল বস্তি, জুরাইন বালুর মাঠ বস্তি, গোপীবাগের টিটিপাড়া বস্তি, মালিবাগের কুমিল্লা বস্তি, মোহাম্মদপুরের বালুর মাঠ বস্তি, মালিবাগের রেললাইন বস্তি, খিলগাঁওয়ের নোয়াখাইল্লা বস্তি, মীর হাজিরবাগ বস্তি, ধলপুর সিটিপল্লী বস্তি, নামাশ্যামপুর বস্তি, গেন্ডারিয়ার রেললাইন বস্তি, পার গেন্ডারিয়া বস্তি, মহাখালীর সাততলা বস্তি, পোস্তগোলা ডিআইটি বস্তি, ডেমরার চরপাড়া বস্তি, পূর্ব দোলাইরপাড় ডিপটি গলির বস্তিসহ বেশির ভাগ বস্তি। ঢাকার বাইরে কুমিল্লা, ফেনী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, শেরপুর, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চুয়াডাঙ্গা, নীলফামারী, দিনাজপুর, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সাতক্ষীরা, বগুড়া, ফরিদপুর, পাবনা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ঢাকার পাশে সাভার, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় কিশোর অপরাধের ঘটনা বেশি। মাদক কেনাবেচা, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, অস্ত্র, নারী ও শিশু পাচার এবং অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত এই অপরাধীরা। মূলত এসব এলাকায় মাদক ব্যবসায় কিশোর অপরাধীরা কোনো না কোনোভাবে জড়িত। এদের নেপথ্যে আছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা।

একাধিক ভুক্তভোগীর দাবি, রাজধানীর জিগাতলা, মিরপুর মাজার রোড, কামরাঙ্গীরচর, বছিলা, আদাবর বায়তুল আমান হাইজিং, উত্তরার জসিম উদ্দিন, সিলেটের জল্লারপাড়, চট্টগ্রামের টাইগারপাসসহ দেশের প্রায় সব থানাতেই কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App