×

মুক্তচিন্তা

উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করা যাবে না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:১৫ এএম

একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য যখন দেশের মানুষ অপেক্ষা করছে তখন একটি দলের মধ্যে নানা অজুহাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার পতনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে তারা দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টের অপপ্রয়াসেই বরং বেশি পরিমাণে লিপ্ত। তাদের এই প্রয়াস সফল করতে দেশ-বিদেশে নানা রকমের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারেও তারা পিছপা হচ্ছে না! এই দলটিও একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। দীর্ঘদিন রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় থেকে এই দলটি ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে জাতির জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনাগুলোকে আড়াল করেছে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার দেশকে অভ্যন্তরীণভাবে যারপরনাই দুর্বল ও পশ্চাদগামী করে তুলেছিল। ২০০৬ সালে তারা নির্বাচনকালীন ‘তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ গঠন নিয়ে একের পর এক যে কাণ্ড করেছিল তারই পথ ধরে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক এক প্রকারের ছদ্ম সেনা শাসনের আবির্ভাব ঘটেছিল- দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা ১/১১ নামে এক ‘মিথ’ তৈরি করেছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো মানুষ সহজেই ‘রাজনীতি’ ভুলে যায়! তাই এক সময়ের কুখ্যাত ভিলেন সহসাই যেমন নায়কের পদে আসীন হয়ে পড়েন তেমনি ইতিহাসের প্রকৃত নায়কও অতিদ্রুত খলনায়ক বা অপনায়কে পরিণত হয়ে পড়েন! সাধারণ মানুষের ইতিহাস-বিস্মৃতির এই প্রবণতা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রকেই বিপথগামী করে তোলে। আবার সেনাশাসিত তৎকালীন সেই তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলেই এদেশের মানুষ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে সুস্থ ও সংস্কৃত রাজনীতিচর্চার ধারা সূচনার প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু এজন্য কেবল সরকারকে দায়ী করলে চলবে না, দেশের দায়িত্বশীল সব রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বও অনেক। যা কোনো পক্ষই তেমন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে বলে আমাদের মনে হয় না। রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা সুরক্ষা করে সাংবিধানিক পন্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষেরই দায়িত্ব রয়েছে বলে আমরা মনে করি। এজন্য সরকারকে যেমন আস্থা অর্জন করতে হয়, তেমনি বিরোধী বলয়কেও কেবল মাত্র ক্ষমতা লাভের মোহে আবিষ্ট না থেকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা সুরক্ষায় দায়িত্বশীল হতে হয়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই আমরা কিছু না কিছু ব্যত্যয়ই দেখছি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন প্রায়। নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধী বলয়ে শুরু হওয়া সরকার পতনের আন্দোলনকে আমরা কতটুকু গণতান্ত্রিক বলে অভিহিত করতে পারি? আন্দোলন মানেই গণতন্ত্র, সরকারের পতন ঘটানোর মানেই কখনো গণতন্ত্র হতে পারে না। আমরা বিরোধী দলগুলোর বিগত কয়েক মাসের আন্দোলন, সংগ্রাম, সভা, সমাবেশ গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। প্রত্যক্ষ করেছি তাদের সমাবেশে দলীয় নেতা ও কর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষের তেমন সমর্থন নেই- সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও যে তেমন একটা নেই তাও বলা যায়। তাই আমাদের বিশ্বাস সরকার পতনের এসব আন্দোলন সাধারণের সমর্থন নিকট ভবিষ্যতেও পাবে বলে মনে হয় না। ফলে বিরোধী দলগুলোকে তাদের গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ সমুন্নত রাখার স্বার্থেই সাংবিধানিক সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এও আমাদের বিশ্বাস যে, বিজয়ীরাই পরবর্তী পাঁচ বছর দেশের ‘ক্ষমতা’ কিংবা ‘দায়িত্বভার’ গ্রহণ করবেন। সবাই জানি, ক্ষমতা হলো ভোগের বস্তু আর দায়িত্ব হলো পালনের বিষয়। স্বাধীনতা লাভের পর বিগত প্রায় ৫২ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামরিক শাসকরা দেশের ক্ষমতা ভোগ করেছেন, কেউ কেউ আবার এই ক্ষমতাকে দায়িত্ব মনে করে তা পালনেরও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ক্ষমতা ভোগ ও দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যে দুটি আদর্শগত ভাগ দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরপরই টের পাওয়া গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের ভেতর পাকিস্তানি আদর্শ ও মনোভাব পোষণকারীদের একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে কেবল মাত্র তার ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতা ভোগের লালসা থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেরণার বিপরীত স্রোতের তথা পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনকারী স্বার্থান্বেষীদের সম্মিলিত এক রাজনৈতিক বলয় তৈরি হয়। এই রাজনৈতিক চক্রটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে যথার্থই ভোগের সামগ্রী বিবেচনা করেছিল। তাই দেখা যায় ক্ষমতাসীন হয়েই মুক্তিযুদ্ধকালীন যে চারটি আদর্শকে বাঙালির মৌল অভিপ্রায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল তা বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রাকে পশ্চাতের দিকে ঠেলে দেয়। পরাধীন পাকিস্তানি শাসনামলে পঞ্চাশ ও ষাট দশকে মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসে যে জাতীয়তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল এই চক্রটি তা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিকৃত এক পথের সন্ধান দিয়ে রাষ্ট্রকে নিজেদের এবং তাবেদারি অন্যান্য রাষ্ট্রের ভ্রান্ত আদর্শের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের গায়ে তারা চাপিয়ে দিয়েছিল মিথ্যার ভারি চাদর। মিথ্যা ইতিহাসের দীর্ঘ এক দায়ভার এদেশের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বহন করতে হয়। বলাবাহুল্য, এখনো সেই দায় মোচন সর্বাংশে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভ্রান্ত ইতিহাস অপনোদনের প্রয়াস আছে, তবে তা আরো দীর্ঘস্থায়ী করতে হবে। ক্ষমতাভোগীদের মিথ্যা ও চাতুরিপনার ইতিহাস এবং সামরিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শাসকগোষ্ঠী খুব সহজেই এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী একটি শক্তিকে বিকশিত হয়ে ওঠার পথ সুগম করে দেয়। তাই ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও বাঙালির জীবন ছিল সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবেই অন্ধকারাচ্ছন্ন। জাতীয় জীবনে এর চেয়ে বড় বিপর্যয় হাজার বছরের পরিক্রমায় বাঙালির ইতিহাসে আর কখনো ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। এখন পর্যন্ত সেই বিপর্যয়ের প্রবল ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্ণিত বিপর্যয়ের এই নেতিবাচক প্রভাব ভবিষ্যতের কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের। উক্ত বিপর্যয়ের ফলেই বর্তমান বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির এক একটি আদর্শিক লড়াই ক্রিয়াশীল আছে। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এ বড়ই কলঙ্কের, বড়ই অপমানের। কী পরিমাণ বেদনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করতে হয় স্বাধীন একটি দেশে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিও রাজনীতির সুযোগ পায়! স্বাধীনতা লাভের ৫২ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমরা দেখছি মীমাংসিত বিষয়ের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির এই দ্বা›িদ্বক অবস্থান। এটি সাধারণকে ব্যথিত করে। ক্ষমতাই রাজনীতিকদের কাছে মুখ্য, আদর্শ বলে কি কিছুই থাকতে নেই? সাধারণ মানুষের কাছে এরকমের কিছু ‘গোবেচারা’ ধরনের প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারে সর্বক্ষণ! এদেশের সাধারণ মানুষ আরো ব্যথিত বোধ করে তখন যখন দেখতে পায় প্রগতিশীল চিন্তার ধারক ও বাহক বলে খ্যাত এদেশের কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীত শক্তির সঙ্গে ‘জোটবদ্ধ’ হয়। এসব প্রগতিবাদীরা যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অবিশ্বাসীদের সঙ্গে ঐক্য স্থাপন করে তখন গণতন্ত্র নিয়ে তাদের হাহাকার আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হয়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলে এরা যখন বিএনপি-জামায়াতকে নিয়ে জোট বাধে তখন আমাদের চোখে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে গণতন্ত্রের করুণ চিত্রের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে হাওয়া ভবনের দ্বৈত শাসনের কথাও! যদি তারা বিএনপি-জামায়াতকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিদের কোনো জোট গঠন করতেন তাহলেও সাধারণের আক্ষেপের জায়গাটি বড় হতো না! আওয়ামী লীগ গত ১৪ বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছে। পরপর তিন মেয়াদে রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র একটি দলের কাছে আছে। তাই সাধারণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে কিছু ব্যবধান থাকতে পারে, নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ভোটারদের বিবেচনার জন্য কিছুটা তো পশ্চাতেও তাকাতে হবে। অর্থাৎ ভোটারদের দেখতে হবে ইতোপূর্বেকার দেয়া প্রতিশ্রæতি পূরণে আওয়ামী লীগ তৎপর ছিল কি না; নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীর বিচার, পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল চালু কিংবা বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নসহ নানা খাতে দেয়া প্রতিশ্রæতি তারা পালন করেছে কি না! নিরপেক্ষভাবে দেখলে বোঝা যাবে, অতীতের যে কোনো সরকারের চেয়ে বর্তমান সরকার তাদের প্রদত্ত প্রতিশ্রæতি বেশি পরিমাণে বাস্তবায়িত করেছে। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বয়স্ক ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে এই বিবেচনাটি কাজ করবে বলে আশা করি। আশা করি এই বিবেচনাটি সামনে নিয়ে হিসাব করে দেখতেও। আবার শুধু উন্নয়নই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির বিষয়টিও তরুণ ভোটারদের মনে সক্রিয় হতে হবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতকে আড়াল করার লক্ষ্যে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে দণ্ডিতদের আড়াল করার লক্ষ্যে, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামিদের বাঁচানোর লক্ষ্যে ডান-বাম কয়েকটি রাজনৈতিক দল জনবিচ্ছিন্ন কিছু নেতাকে নিয়ে বিএনপি-জামায়াত এক অপরিণামদর্শী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। এই ষড়যন্ত্রের জাল দেশ-বিদেশে বিস্তৃত। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে ক্ষমতার লোভে যারা দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের সচেতন মানুষ তাদের প্রতিহত করার মধ্য দিয়ে যথাসময়ে যথোপযুক্ত জবাব দেবেন। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App