×

জাতীয়

১৭ বার সময় নিলেও শেষ হয়নি তদন্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:২১ পিএম

১৭ বার সময় নিলেও শেষ হয়নি তদন্ত

ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর কলাবাগানে চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি খুনের ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ ১৭ বার পেছালেও এখনো হত্যা রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি। হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পেরুলেও এখনো নৃশংস খুনের কারণ খুঁজছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি ফের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার দিন ধার্য করেছেন আদালত।

২০২১ সালের ৩১ মে কলাবাগান ফার্স্ট লেনের ৫০/১ হোল্ডিংয়ের বাড়ির তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ ডা. সাবিরার মরদেহ উদ্ধার করে। শয়নকক্ষে তাকে ছুরিকাঘাত ও জবাই করে হত্যা করা হয়। পুলিশের ধারণা, ৩০ মে রাত ১১টা হতে ৩১ মার্চ সকাল ১০টার মধ্যবর্তী সময়ে খুন হন ডা. সাবিরা। এ ঘটনায় নিহতের মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি কাগজে-কলমে থানা পুলিশ তদন্ত করলেও র‌্যাব ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট আলাদাভাবে ছায়াতদন্ত শুরু করে। হত্যা রহস্যের গতি করতে না পারায় মামলা তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) দায়িত্ব দেয়া হয়।

তদন্ত সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, এতটাই চতুরতার সঙ্গে খুন করা হয়েছে, ঘাতকরা কোনো চিহ্ন রাখেনি। যে কারণে একটু সময় লাগছে। তবে ঘনিষ্ঠজনদের কেউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সন্দেহের এ তালিকার পুরোভাগে রয়েছেন ডা. সাবিরার স্বামী এ কে শামছুদ্দিন আজাদ। নানা তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে ডা. সাবিরার স্বামীকে গত বছরের ১৯ এপ্রিল এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসাবে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাইলে আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর ২১-২৩ এপ্রিল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি অসুস্থ হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে একজন

চিকিৎসকের উপস্থিতিতে। তবে তিনি হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি। নানাভাবে এড়িয়ে গেছেন। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বাইরে রয়েছেন তিনি। সন্দেহ করার নানা কারণের বিষয়ে জানা গেছে, ব্যাংকার একে শামছুদ্দিন আজাদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে ২০০৬ সালে ডা. সাবিরার বিয়ে হয়। পরের বছর ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর মেয়ে নুসাইবা আনবারের জন্ম হয়। এর আগে ডা. সাবিরা চট্টগ্রামের একটি মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ১৯৯৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর উবাইদ উল্লাহ নামে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৯৯ সালে সেই ঘরে ছেলে আহমেদ তাজোয়ারের জন্ম হয়। ২০০৩ সালের ৩০ জুন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ডা. উবাইদ উল্লাহ। এরপর থেকে ছেলে তাজোয়ার কলাবাগানে তার নানির বাসায় থাকত। আর দ্বিতীয় বিয়ের পর ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত ডা. সাবিরা কখনো তার মায়ের কলাবাগানের বাসা ও কখনো স্বামীর শান্তিনগরের বাসায় থাকতেন। তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। যে কারণে ডা. সাবিরা স্বামীর বাসায় স্থায়ীভাবে থাকতেন না। ২০১৭ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর ডা. সাবিরা তার বাবার বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।

আরো জানা গেছে, ডা. সাবিরার সঙ্গে বিয়ের আগে একে শামছুদ্দিন আজাদ আরো দুটি বিয়ে করেন। এরমধ্যে তিনি ডা. সাবিরার কাছে একটি বিয়ের কথা গোপন করেন। এ বিষয়টি জানার পরই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চরম বিরোধ শুরু হয়। যেদিন কলাবাগানের ভাড়া বাসায় সাবিরার মরদেহ উদ্ধার হয়, সেদিন সেই ঘর থেকে ৩০০ টাকা মূল্যের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লেখা তালাকনামা জব্দ করেছিল পুলিশ। সেটি ২০১৬ সালের ২২ মার্চের। সেই তালাকনামা ঘিরে রহস্য এখনো রয়েই গেছে। বিচ্ছেদের জন্য সাবিরা সেটি প্রস্তুত করিয়েছিলেন বলে ধারণা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের। এদিকে আজাদের আগের পক্ষের মেয়ে মিথিলা মা হিসেবে মেনে নেয়নি সাবিরাকে। হত্যার ঘটনায় মামলার বাদী সাবিরার মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার জুয়েল গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা অনেক সময়ই হতাশার সৃষ্টি করে। যদিও আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সেই প্রেক্ষিতে পথ চেয়ে আছি পিবিআই ভালো খবর দেবে। আস্থা রাখতে চাই বোন হত্যার বিচার পাব।

মামলাটি তদন্ত করছেন পিবিআই ঢাকা মহানগর উত্তরের পরিদর্শক জুয়েল দেওয়ান। তদন্তে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত অন্তত ৩৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন- বাড়ির মালিক, দারোয়ান, কেয়ারটেকার, সাবলেটের ভাড়াটে কানিজ সুবর্ণা, সাবিরার বান্ধবী, ছেলেমেয়ে, ছেলের বন্ধু, তার কর্মস্থল গ্রিন লাইফ হাসপাতালের সহকর্মী, গৃহপরিচারিকা, আজাদের ব্যক্তিগত গাড়িচালক, আত্মীয়স্বজন এবং আগুনের খবর শুনে আসা ফায়ার সার্ভিসের ৫ কর্মীকে। এছাড়া ৮টি মোবাইলের ফরেনসিক প্রতিবেদন পরীক্ষা করা হয়েছে। সাবিরার ছেলেমেয়ে, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের মোবাইল নম্বরের সিডিআর পর্যালোচনা করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এতে হত্যারহস্য উদ্ঘাটনের মতো কিছুই পাওয়া যায়নি।

এদিকে কলাবাগানের প্রথম লেনের ৫০/১ নম্বর ভবনের তৃতীয়তলার ওই ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে তিনি একা থাকতেন। অপর একটি কক্ষ ভাড়া দেন কানিজ সুবর্ণা নামের এক মডেলকে। আরেকটি বিনামূল্যে থাকতে দেন নুরজাহান নামের এক তরুণীকে। ওই তরুণী তাকে আরবি পড়াতেন। তবে ঘটনার আগেই নুরজাহান তার গ্রামের বাড়িতে চলে যান। কানিজ সুবর্ণা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের বলেছেন, ঘটনার আগের রাতে বাসায় ফিরে দেখেন, সাবিরার কক্ষ ভেতর থেকে আটকানো। রাত সাড়ে ১০টার দিকে উত্তেজিত সুরে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলতে শোনেন সুবর্ণা। ফোনে তুমুল ঝগড়া হচ্ছিল। অবশ্য সাবিরার ফোনের ফরেনসিক প্রতিবেদনে সে তথ্য উঠে এসেছে। ওই রাতে প্রায় ২৬ মিনিট মেসেঞ্জারে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়। স্বামী ও সাবিরার সম্পদের হিসাবসহ অর্থনৈতিক-সংক্রান্ত তথ্যও সংগ্রহ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কারো শত্রুতা ছিল কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সন্দেহজনক বিভিন্নজনের মোবাইল ফোন বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছেন, আজাদের ব্যক্তিগত গাড়িচালক সাইফুলের বাসা মালিবাগ এলাকায়। তিনি কখনো শান্তিনগরের আজাদের বাসায় রাত কাটাননি। অথচ ৩০ মে রাত দেড়টার দিকে সাইফুল আজাদের বাসায় গিয়ে রাত কাটান। ভোর ৪টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত সাইফুল ও আজাদের ফোন বন্ধ ছিল। এ বিষয়টিও মুখ্য সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে আজাদ তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি করেন, তিনি ও চালক ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলেন। সকাল ১০টার পর ফোন খুলেই সাবিরার মৃত্যুর খবর পান তিনি। ওই রাতে সাইফুল মালিকের বাসায় থাকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা। এরই মধ্যে আজাদ তাকে চাকরিচ্যুত করেছেন। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে সাবিরার মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময় জানা যায়নি। পিবিআই ঢাকা মহানগর উত্তরের পরিদর্শক জুয়েল দেওয়ান গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, গুরুত্বসহকারে মামলাটির তদন্ত ও রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App