×

জাতীয়

ঢাকা মহানগরের নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ-অবিশ্বাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:২৭ এএম

ঢাকা মহানগরের নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপিতে সন্দেহ-অবিশ্বাস

ফাইল ছবি

তৈরি হচ্ছে আঁতাঁতকারীদের কালো তালিকা

নতুন কমিটি গঠনের পরিকল্পনা

রাজধানী শহর ঢাকাকে মূল ‘টানিং পয়েন্ট’ ধরেই আন্দোলনের ছক কষছে রাজপথের অন্যতম প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। অথচ নগর নেতৃত্বে সন্দেহ, অবিশ্বাস আর শঙ্কা দিন দিন তীব্র হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে আঁতাঁত, দলীয় পরিকল্পনা ফাঁস করা, কর্মসূচিতে অংশ নেয়ায় অনাগ্রহসহ নানা অভিযোগ উঠেছে মহানগর নেতাদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে উত্তেজনার পারদ চড়ছে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকেও। পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে বিএনপির ঢাকা মহানগরের আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে নতুন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেয়ার কথা ভাবছেন দায়িত্বশীলরা। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে।

বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে দারুণভাবে চাঙ্গা হয়েছিল বিএনপি। তবে ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে শুরু করে সম্প্রতি যুগপৎ আন্দোলনের বড় কয়েকটি কর্মসূচি হোঁচট খেয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, কর্মসূচি সফলে ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত

নেতারা কর্মী জড়ো করা তো দূরের কথা, অনেকে মাঠেই ছিলেন না। এছাড়া স্বজনপ্রীতি, টাকার লেনদেন এবং নিজের বলয় সৃষ্টি করতে গিয়ে আমিনুল উত্তর বিএনপিকে দুর্বল করেছেন। আর সরকারের সঙ্গে আমান উল্লাহ আমানের আতাঁতের গুঞ্জন এখন নেতাকর্মীদের মুখে মুখে।

সূত্র জানায়, কেবল আমানউল্লাহ কিংবা আমিনুল নন, সন্দেহজনক গতিবিধির কারণে কিছু নেতাকে দাঁড় করানো হচ্ছে কাঠগড়ায়। তৈরি করা হচ্ছে কালো তালিকা। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের সমন্বয়ক কমিটি তদন্ত শুরু করেছে। ১০ ডিসেম্বর সমাবেশসহ পরবর্তী বড় কর্মসূচির দিন কার কী ভূমিকা ছিল, কে কোথায় ছিলেন- এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে এ কমিটি। এরপর ওইসব নেতাদের অপারগতার কারণ জানতে চেয়ে শোকজ করা হবে। সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ নেতাদের দল থেকে বহিষ্কারেরও চিন্তাভাবনা চলছে। এই অজুহাতে ভেঙে দেয়া হতে পারে আহ্বায়ক কমিটি।

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের ভাষ্য- রাজনীতির গতির সঙ্গে কর্মসূচি দিয়ে তাল মেলানো কঠিন হচ্ছে। নরম কর্মসূচি দিয়ে গরম দাবি আদায় করা দুরূহ। এই মুহূর্তে ঢাকা মহানগরের মূল সমস্যা চিহ্নিত করে সন্দেহভাজন নেতাদের বাইরে রেখে আন্দোলনের পরিকল্পনার কথা ভাবছেন তারা। ২০১৪ সালের আন্দোলন ঢাকার নেতাদের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। এবারো তেমন কিছু হলে বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে ইউটার্ন নিতে হবে। তাই এই মুহূর্তে যেসব নেতা রয়ে সয়ে কর্মসূচি দেয়ার কথা বলে বিএনপিকে বিভ্রান্ত করে সরকারকে গুছিয়ে নেয়ার সময় দিচ্ছে তাদের দল থেকে সরাতে হবে। যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে মহানগরকে পোক্ত করে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচির বিকল্প নেই।

অভিযোগের তীর আমানের দিকে : ঢাকা মহানগর কমিটি ঘিরে অস্থিরতার মূল কারণ উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান। ‘১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবে’- দলের এক প্রতিবাদ সমাবেশে তার এমন হুঁশিয়ারির পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতির মাঠ। তার হুঁশিয়ারির পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে শুরু হয় কথার লড়াই, হুমকি-পাল্টা হুমকি। এর জেরেই ১০ ডিসেম্বর ঘিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। বিএনপির ৮ জন কর্মী নিহত হন, অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেপ্তারসহ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়েও তৈরি হয় শঙ্কা। ফলে অভিযোগের তীর এখন আমানের দিকেই। দলের ভেতরে প্রশ্নে উঠেছে- বিএনপির দলীয় পরিকল্পনা আমান কেন প্রচার করবে? নিশ্চই এখানে তার কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। ১০ ডিসেম্বর সমাবেশে মাঠেও অনেককে বলতে শোনা যায় আমানই মূল দুষ্কৃতকারী। তার জন্যই মহাসচিব জেল খেটেছেন।

সূত্রের দাবি, আমানউল্লাহ আমান সমাবেশ সফল করতে দলের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে ঢুকিয়েছেন, যার এক ভাগও খরচ করেননি। এমনকি ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টন থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পরের দিনই তার জামিন লাভ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। দলের ভেতরেই কেউ কেউ বলছেন, আমানউল্লাহ আমান সরকারের গুপ্তচর। এ নিয়ে শীর্ষ নেতাদের সন্দেহ- যার বক্তব্যের জেরে দলের গুছিয়ে আনা পরিকল্পনা ভেস্তে গেল, সবাই গ্রেপ্তার হলো, তাকেই আবার কারাগারে নেয়ার আগে ছেড়ে দেয়া হয়! এতে সাধারণ নেতাকর্মীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও আমানউল্লাহ আমান ফোন ধরেননি।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজেকে বলেন, বিএনপির চলমান আন্দোলনের একমাত্র অর্জন নেতাকর্মীদের উজ্জ্বীবিত মনোবল। যেটা আগে ছিল না। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে। কঠোর হুঙ্কার দিয়ে নরম কর্মসূচির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, কর্মীরা সহিংস কর্মসচি চায়, যেটা হুট করে হয় না। এর জন্য আগে প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হয়।

সরকারের সঙ্গে কিছু নেতার সমঝোতার গুঞ্জনের বিষয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে এসব আলোচনায় আসে। তবে বিএনপির সমঝোতায় আসার মতো দূরবস্থায় পড়েনি। কোনো নেতা যদি মনে করে, সরকারের সঙ্গে আঁতাঁত করে চলতে পারে। প্রমাণ পেলে দলের পক্ষ থেকে উচিত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঢাউস কমিটির লোকজন কোথায় : দলীয় কার্যালয়ে হামলা এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতাকর্মীদের গণহারে আটকের পর কোনো শক্তিশালী কর্মসূচি দেয়নি বিএনপি। ৭ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একা একা কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে ফুটপাতে অসহায়ের মতো বসেছিলেন। অথচ বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর ৩০০ থেকে ৪০০ সদস্যের ঢাউস আকারের কমিটির নেতারা কোথায় ছিলেন, তা কেউ জানেন না।

এছাড়া যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি হিসেবে গণমিছিল, গণঅবস্থান, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। এসব কর্মসূচিতেও মহানগরের নেতাকর্মীদের আশানুরূপ উপস্থিতি নেই। এজন্য মহানগর কমিটির দুর্বলতাকে দায়ী করা হচ্ছে।

১৫ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ নিয়ে সন্দেহ : ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়ার পরে প্রেস ক্লাবমুখী ১৫ সংগঠন নিয়ে একটি জোট গঠন করে বিএনপি। কিন্তু এই জোট নিয়ে দলটির শীর্ষ নেতারাই অন্ধকারে। ১৫ সংগঠন নিয়ে জোট করল কে? ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়ার পর এই জোট গঠনের রহস্য জানে না বিএনপির হাইকমান্ড।

সূত্র জানায়, ১৫ দলীয় জোট নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কয়েকজন নেতা আপত্তি তুলে বলেছেন। ছোট ছোট দল নিয়ে গুলশান অফিসে যে জোট হয়েছে তারা কি আসলে রাজনৈতিক দল? কোনো নিবন্ধন আছে এদের? এটা কারা করছে, কীভাবে করছে? এ জোট আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু থাকলেও তিনি এ বিষয়ে অন্ধকারে। পুরো প্রক্রিয়াটি তত্ত্বাবধান করেছেন আমানউল্লাহ আমান। একজন নেতা জানতে চান, আমানকে দলের কর্তৃত্ব কে দিয়েছে? এ সময় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও বলেন, তাকেও এ জোট গঠনের বিষয়ে অবহিত করা হয়নি।

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ : বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নিয়মিত আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মহানগর বিএনপির ব্যর্থতা। সর্বশেষ গত সোমবারের বৈঠকেও কয়েকজন নেতা ক্ষোভ ঝাড়েন আমানউল্লাহ আমানকে নিয়ে। এর আগে বৈঠকে বিএনপির সিনিয়র নেতা মির্জা আব্বাস ক্ষোভ প্রকাশ করেন- ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় মুখ ফসকে একটি বক্তব্য দিয়েছিলাম, সেই ঘটনায় আমার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। তাহলে আমানের কাছে কেনো ব্যাখ্যা চাওয়া হবে না? এরপর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিষয়টি মহাসচিবকে দেখতে বলেন। বৈঠকে ওই নেতা আরো বলেন, সরকারের লোকজন সঙ্গে নিয়ে তো সরকারবিরোধী আন্দোলন করা যাবে না।

ঢাকা মহানগর কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ বা অবিশ্বাস চলছে কিনা জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলামের উত্তর- ‘দিস ইস ভ্যারি ক্রিটিক্যাল কোরসেন ফর মি’।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App