×

মুক্তচিন্তা

সক্ষমতা আছে বলেই বাংলাদেশ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৫৬ এএম

দেশে বর্তমানে যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা হচ্ছে আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সেগুলো নিয়ে নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, সমালোচনা এবং মেগা দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিন থেকে করে আসছে। মেগা প্রকল্প নিয়ে মেগা দুর্নীতি হচ্ছে- এ কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। তবে কী ধরনের মেগা দুর্নীতি কোন মেগা প্রকল্পে হচ্ছে সেই তথ্য-উপাত্ত যদি তারা দেখাতেন তাহলে তাদের সমালোচনা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ জনগণের কাছে সমাদৃত হতো। কিন্তু তেমন কোনো নজির এ পর্যন্ত তারা স্থাপন করতে পারেননি। তারা আরো বলার চেষ্টা করেন যে, এই সরকার বাংলাদেশে অধিক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে দেশকে শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করতে যাচ্ছে। সরকার তাদের এসব অভিযোগ সবসময় নাকচ করে দিয়ে এসেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোরও মেগা প্রকল্প নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি উত্থাপন করতে শোনা যায়নি। পদ্মা সেতু শুরুর প্রাক্কালে এর ঋণ গ্রহণ নিয়ে বিশ্বব্যাংক এক ধরনের কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল। সেই অভিযোগ নিয়ে আমাদের দেশের গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক দলগুলো এতটাই সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা মুখর হয়েছিল যে, বিশ্বব্যাংক টাকা দিয়েছে কি দেয়নি সেই সংবাদ না জেনেই সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা টাকা ভাগাভাগি, কাজ পাওয়া ইত্যাদি নিয়ে কল্পিত গুজব প্রচার, অপপ্রচারে দেশকে মাতিয়ে তুলেছিল। সর্বত্র পদ্মা সেতুর টাকা ভাগাভাগির গালগল্প নিয়ে রসাত্মক সব আলোচনা চলছিল। কিন্তু সরকার যতই এর প্রতিবাদ এবং অস্বীকার করছিল কেউ তা বিশ্বাস করতে রাজি ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক যখন না দেয়ার ঘোষণা দেয় তখন জানা গেল টাকাই তখনো দেয়া হয়নি, ভাগাভাগির কথা কল্পিত যে সেটিও অনেকেই চিন্তা করে বুঝতে চায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন, নানারকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ছুড়ে দিয়েছিলেন এবং পদ্মা সেতুর ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে এ রকম কথাও অনেকে বলেছিলেন। কিন্তু পদ্মা সেতু ঠিকই নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের এই সক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়েছে। বাংলাদেশ সত্যি সত্যি নিজস্ব অর্থে এত বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে তা নিয়ে কারো কারো সন্দেহ থাকলেও পদ্মা সেতু যত দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল তত বাংলাদেশের সক্ষমতাই যেন সবাইকে জানান দিচ্ছিল। তারপরও আমাদের বিরোধী দলগুলো পদ্মা সেতুর বিরোধিতা করা ছাড়েনি, পদ্মা সেতুতে ‘প্রচুর’ দুর্নীতি হয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছিল। দেশে মেগা প্রকল্প বিদ্যুৎ খাতে কয়েকটি প্রকল্প সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক মেগা প্রকল্পের কথা অনেকে ভাবতেই পারেনি। চট্টগ্রাম কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের কথাও অনেকের ধারণার বাইরে ছিল। মেট্রোরেলের কথাও অনেকটা কল্পনাতে ছিল না। বড় বড় হাইওয়ে অনেকগুলো সম্পন্ন হয়ে গেছে, অনেকগুলোর কাজ চলছে, এলিভেটেড এক্সপেসওয়ে ইত্যাদি নিয়েও কাজ চলছে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে গত ১২-১৩ বছরে যে বিশাল সক্ষমতা তৈরি হয়েছে তা অতীতে কল্পনা করা যায়নি। কিন্তু এই অল্প কয়েক বছরেই আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন ২৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। দেশে এখন একসঙ্গে ১০০টি সেতু, ১০০টি সড়ক, ৫০টি চারতলাবিশিষ্ট মসজিদ একসঙ্গে অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে উদ্বোধন করা হয়েছে। সরকার বিনামূল্যে ২ শতক জমির ওপর ১টি করে আধাকাঁচাপাকা বাড়ি বিনা পয়সায় আশ্রয়হীন, গৃহহীন হতদরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিতরণ করেছে। ইতোমধ্যে এই সংখ্যা সাড়ে ৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ ধরনের আরো অসংখ্য প্রকল্প দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে যেগুলোর প্রত্যেকটিই একেকটি মেগা প্রকল্প এবং এগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক গুরুত্ব কমবেশি এখন সবারই উপলব্ধিতে আসতে শুরু করেছে। বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো এখন বাংলাদেশকে নানা ধরনের মেগা প্রকল্প গ্রহণ করতে উৎসাহিত করছে। তাদের সব সুপারিশই আমাদের গ্রহণ করতে হবে এমন কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে যদি কোনো মেগা প্রকল্পের প্রস্তাব থেকে থাকে তাহলে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু দেশের খুব বেশি উপকারে আসবে না এমন মেগা প্রকল্প নিশ্চয়ই আমরা চাইব না। আমাদের ধারণা সরকার এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছে। তাছাড়া এই মুহূর্তে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট আমাদের ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে এই মুহূর্তে নতুন মেগা প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি সরকার ভেবেচিন্তে নেবে এটাই আমরা আশা করি। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ ২০০৮ সালের আগে ছোট ছোট বিদেশি প্রকল্প নিয়ে যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে চেষ্টা করেছিল তাতে উন্নয়ন খুব বেশি গতি লাভ করেনি। আমাদের সক্ষমতাও তখন খুব একটা বাড়েনি। বিদেশি প্রকল্পের একটি বড় অংশ বিদেশিরাই ঘুরিয়ে নিয়ে যায়, আমাদের আমলা-কামলারাও তাদের স্বার্থ ভালো করে আদায় করে নেয়। প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিজ্ঞতা আমাদের দীর্ঘদিনের। এখনো দেশীয় অর্থেই হোক আর বিদেশি অর্থেই হোক দুর্নীতি যারা করার তারা করেনই। প্রকল্পের মেয়াদও বাড়িয়ে টাকার বরাদ্দ বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা থামেনি। এই অভিজ্ঞতা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য সুখের নয়। তবে মনে হয় মেগা প্রকল্পগুলোতে বিশাল অঙ্কের কাজ হলেও এখানে অনেকটা পরিবীক্ষণ তদারকি চলার কারণে মেগা দুর্নীতির সুযোগ ততটা হয় না যতটা বাইরে থেকে বলা হয়। তবে মেগা প্রকল্পগুলো হওয়ার ফলে দেশের উন্নয়নের গতিধারা আগের ছোট ও মাঝারি প্রকল্পের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এর ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন দ্রুত আসতে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ খাতে যদি আমাদের উন্নয়ন স্বল্প সময়ে এতটা না ঘটত তাহলে গোটা অর্থনীতিই স্থবির হয়ে যেত, জীবনমানের নিম্নগতি রোধ করা যেত না। অর্থনীতি ভেঙে পড়ত। ব্যবসা-বাণিজ্য চারদিকে এভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারত না। বিদ্যুৎ আমাদের সমগ্র জীবন ব্যবস্থায় যে গতির পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তা এককথায় অকল্পনীয়। গ্রামের অর্থনীতি এখন কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা গ্রামে গেলেই বোঝা যায়। কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নে বিদ্যুৎ, সার, যোগাযোগ ব্যবস্থা কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করছে তা সংশ্লিষ্টরাই ভালো বুঝতে পারেন। করোনা এবং করোনা-উত্তরকালে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে অনেকটাই দেশের কৃষি এবং গার্মেন্টস শিল্প ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। এসব খাতে পরিবর্তনের পেছনেই ছিল বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ। সেটি না করা হলে দেশের অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়ে যেত। সেক্ষেত্রে ১৭ কোটি মানুষের দেশে বর্তমানে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো সম্ভব হতো কিনা বলা মুশকিল। আমাদের বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলো একদিকে বিপুল কর্মসংস্থান, সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও সরবরাহকারী নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে আমাদের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে দক্ষতা এবং উন্নয়ন চিন্তার অধিকারী হয়ে উঠেছে। এরাই এখন দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম জনশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। অনেকে দেশের বাইরেও অভিজ্ঞতা নিয়ে চলে যাচ্ছে। তাদের প্রেরিত রেমিট্যান্স বাংলাদেশ পাচ্ছে এবং পাবেও। বস্তুত মেগা প্রকল্পগুলো আমাদের দৃষ্টিকে অনেকদূর নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। বিদেশিরা আমাদের এখন ঋণ দিতে ভয় পাচ্ছে না। কারণ গত এক যুগে নানা ধরনের মেগা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার মাধ্যমে আমরা বড় বড় কাজের যেমন সক্ষমতা অর্জন করেছি, উন্নয়ন উৎপাদনশীলতার পরিচয় দিতে পেরেছি। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে আমাদের বাজেট যেখানে ছিল মাত্র ৬৯,৭৪০ কোটি টাকা সেটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকা। এটি ভাবতেই এখন আমাদের গর্বে বুক ভরে যায়। এত অল্প সময়ে আমরা এত দ্রুত আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছি, সেটি মোটেও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই বরং এটি আমাদের সক্ষমতারই বড় দলিল। বাংলাদেশের এই পরিবর্তনের পেছনে ছিল শেখ হাসিনা সরকারের দিনবদলের সনদ তথা রূপকল্প-২০২১। শেখ হাসিনা সরকার একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে মেগা প্রকল্পের অবস্থান অন্যতম। এর আগে কোনো সরকার মেগা প্রকল্পের ধারণাই জাতির সম্মুখে তুলে ধরতে পারেনি। বিরোধীরা এসব মেগা প্রকল্পের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তথ্য প্রমাণবিহীনভাবে করে যাচ্ছে তাতে তাদের ‘মনোবেদনার’ প্রকাশ যেন ঘটছে। তাদের শাসনামলে মেগা প্রকল্প বাংলাদেশ দেখেনি, শেখ হাসিনা শুধু দেখাননি বাস্তবায়নও করে চলছেন। এটি বোধহয় তাদের খুব ভালো লাগছে না। সে কারণেই কথায় কথায় মেগা প্রকল্পের মেগা দুর্নীতির কথা উচ্চারণ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানা কল্পকাহিনী ছড়ানো হয়েছে এবং হচ্ছে। নানা মিথ্যা তথ্য দেয়া হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার পরও বলা হচ্ছে যে, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মূলে বিদেশি অর্থ ঋণ নাকি আমাদের দিতে হচ্ছে! সে কারণেই সংকট বেড়ে চলছে। এ ধরনের নানা বানোয়াট তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়। ইদানীং এসব অপপ্রচার কমে আসছে। কারণ পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ যাতায়াত ব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে তা সবাই প্রত্যক্ষ করছে। তাছাড়া পদ্মা সেতুর টোল আদায়ের মাধ্যমে শুধু বড় অঙ্কের অর্থই আসছে না, ডিজিটাল পদ্ধতির উন্নত সংস্করণ কার্যকারিতার সক্ষমতা অর্জিত হচ্ছে- এটি সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করছে। সুতরাং দেশ ক্ষুদ্র প্রকল্প থেকে মাঝারি, মাঝারি থেকে মেগা প্রকল্পে উন্নীত হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সক্ষমতাও আন্তর্জাতিক মানে বাড়িয়ে দিচ্ছে সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো সে কারণেই বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পের নানা প্রস্তাব নিয়ে আসা শুরু করেছে। এখন আমরাই সিদ্ধান্ত নেব কোনটা আমাদের প্রয়োজন, কোনটা নেব, কোনটা নেব না। বাংলাদেশ সেই সক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App