জোশীমঠের মতো দার্জিলিং কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে?
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:২৮ এএম
ফাটল শুরু হয়েছিল গত ২ জানুয়ারি থেকে। হিমালয়ের কোলে উত্তরাখণ্ডের ছোট শহর জোশীমঠ আজ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। ফাটল বাড়ছে, ধসে পড়ছে বাড়ি, ভেঙে পড়েছে মন্দির, রাস্তায় অতলান্ত ফাটল। বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় রাত কাটাচ্ছে সব হারানো ৬০০ পরিবার স্রেফ বাঁচার প্রত্যাশায়। উত্তরাখণ্ড সরকার নোটিস দিয়ে ঘোষণা করে দিয়েছে, বসবাসের জন্য উপযুক্ত এবং নিরাপদ নয় জোশীমঠ। অর্থাৎ মৃত্যু ঘটছে ভারতের একটি পাহাড়ি শহরের। জোশীমঠের বিপর্যয় কিন্তু আচমকাও নয়। এই জনপদের সুরক্ষা নিয়ে ১৯৭৬ সাল থেকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে এবং যথারীতি সব সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বেশ কিছু কাল আগে থেকেই জোশীমঠের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরছিল, মাটি সরছিল ধীরগতিতে। যে অঞ্চলে বহু আগেই ভারী নির্মাণকাজ, গাছ কাটা, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো উদ্যোগগুলো বন্ধ রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা, সেখানে উন্নয়ন প্রকল্প অব্যাহত থেকেছে। প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় প্রকল্পগুলোতেও বাধা পড়েনি। এই মুহূর্তে উন্নয়নমুখী ঢাকের আওয়াজ এতই তীব্র, চাপা পড়ে গেছে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বিস্ফোরণ ঘটানো সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দাদের তীব্র আপত্তিও। শুধু জোশীমঠই নয়, সমগ্র উত্তরাখণ্ডের পাহাড়জুড়েই অধিকাংশ নতুন সরকারি ভবন, অপরিকল্পিত বাজার, বহুতল, ঘিঞ্জি সড়ক গড়ে উঠেছে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়। ন্যূনতম বিপর্যয় সুরক্ষাবিধিটুকুও মানা হয়নি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ করে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিংয়ের রিপোর্ট জানাচ্ছে, ওই সময় জোশীমঠ ও আশপাশের এলাকার পাহাড়ে অনেক ফাটল দেখা গেছে। তারপরও কেন্দ্রীয় সংস্থা এনটিপিসির তপোবন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ বন্ধ করা হয়নি। বন্ধ করা হয়নি পাহাড়ের অন্দরে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করার কাজ। ফাটল ঘিরে জোশীমঠ যখন আতঙ্কের প্রহর গুনছে, সেই সময় যেন অশনিসংকেত পেলেন উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার (এই জেলারই অন্তর্গত জোশীমঠ) কর্ণপ্রয়াগের জনতা। কর্ণপ্রয়াগেরও বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা গেছে। নেমেছে ধস। জোশীমঠের মতো ডুবতে পারে নৈনিতালও। এই আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন ‘সেন্টার ফর ইকোলজি ডেভেলপমেন্ট এন্ড রিসার্চ’-এর ডিরেক্টর বিশাল সিংহ। ১৮৬৭ সাল থেকে সে শহরে ভূমি বিপর্যয়ের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। নৈনিতালের মতো পিথোরাগড় জেলাও বিপদের মুখে। সেখানেও অতীতে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, আমাদের রাজ্যের পাহাড়ি শহরের ভবিষ্যৎ কী! আমাদের প্রতিবেশী সিকিমের।
দার্জিলিং শহর তৈরি হয় ১৮৩৫ থেকে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের সময়। সেই সময় ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল ‘বিল্ডিং নর্মস ও আর্কিটেকচারাল গাইডলাইন্স’। পাহাড়ের সুরক্ষিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তৈরি হয়েছিল এই গাইডলাইন। ব্রিটিশ আমলে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হতো এই গাইডলাইন। কিন্তু তারপর? ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে ব্রিটিশ নির্দেশিকা। দার্জিলিংয়ের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল মাত্র পাঁচ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের ওপর হাজার তিরিশেক মানুষের জন্য একটি শহর তৈরি করা। তখন পরিষ্কার বলা হয়েছিল, দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি শিলা শুধু ভঙ্গুরই নয়, এর কাঠিন্যও বেশ কম। পাশাপাশি এ অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত অত্যন্ত বেশি, মাটির জলধারণের ক্ষমতা তুলনায় কম। ফলে নগরায়ণের জন্য উঁচু বাড়িঘর ও চওড়া রাস্তা দার্জিলিংয়ে কখনোই টেকসই হবে না। এ তো গেল সেই সময়ের কথা। এ শতকের গোড়ায় তৈরি সরকারি বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাব এখনো আলোর মুখ দেখেনি। কী বলা হয়েছে সেখানে? বলা হয়েছে- দার্জিলিং একটা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছে। আজ নয়, অনেক দিন ধরেই। তার বিপন্নতা উত্তরাখণ্ডের তুলনায় কম তো নয়ই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং বেশি। বলা হয়েছে, দার্জিলিং ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাড়িঘর এবং রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে স্লোপ স্টেবিলিটি টেস্ট বা ঢালের স্থায়িত্ব পরীক্ষা অবশ্য প্রয়োজনীয়, পাহাড়ি এলাকায় ঢাল ৩০ ডিগ্রির মধ্যে হলে তবেই সেখানে নির্মাণ হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে কী? দার্জিলিং ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৬৫ ডিগ্রি খাড়াই ঢালের ওপরও বহুতল নির্মাণ চলছে। কেন? কারণ এলাকা ও মানুষ দুইই বেড়েছে বহু গুণ, পরিকাঠামো আদৌ পাল্লা দিয়ে বাড়েনি। ১৮৭২ সালে দার্জিলিংয়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করতেন ২৯ জন, ২০০১ সালে তা দাঁড়ায় ৪২১, এখন ৫০০ থেকে ৬০০। তারা থাকবেন কোথায়? তার ওপরে পর্যটকের ভিড়। বাঙালি ছুটি মানেই হামলে পড়ে পাহাড়ে। কাজেই বেড়েছে নগরায়ণের চাহিদা, প্রচুর গাছ কাটা, রাস্তা চওড়া করার উদ্যোগ। যত্রতত্র তৈরি হয়েছে পাকা বাড়ি, হোটেল, স্কুল। আর গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণ। প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহার পাহাড়ি ঝোরাগুলোকে বন্ধ করে দিচ্ছে। কাজেই জল নামছে অন্যপথে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। আলগা হচ্ছে পাহাড়। তাই কথায় কথায় ধস নামছে।
একই অবস্থা পাহাড়ের অন্যান্য শহরগুলোতে। ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ (জিএসআই) কালিম্পং, কার্শিয়াংসহ দক্ষিণ-পশ্চিম দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে যে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়েছে- এই শহরগুলো ধসপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। তাদের করা ‘জাতীয় ধসপ্রবণ মানচিত্রে’ বলা হয়েছে যে, দার্জিলিং পার্বত্য এলাকার মোট ভূখণ্ডের পরিমাণ ২,৯২৩ বর্গকিলোমিটার। এর ১৭ শতাংশই অতি ধসপ্রবণ, ৪০ ভাগা মাঝারি ধসপ্রবণ। মিরিকের তিনধারিয়া, লিম্বুধার, কার্শিয়াংয়ের গিদ্দাপাহাড়, গয়াবাড়ি, পাগলাঝোরা, দ্বারগাঁও গ্রামগুলো অতি ধসপ্রবণ অঞ্চল। সিকিমের ভূখণ্ড রয়েছে ৪,৯৯৫ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৩,৬৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সিকিমের মূল জনবসতি। কিন্তু সিকিম যেভাবে তিস্তায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীবাঁধ তৈরি করছে, তা সিকিমের মাটিকে ক্রমেই ভঙ্গুর করে তুলছে। তার ওপর টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার ফলে গোটা হিমালয়ের পাথর ক্রমেই ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। যার জেরেই দার্জিলিং-সিকিম এলাকায় অতি বৃষ্টিতে ধস নামছে। কাজেই প্রশ্ন উঠছে দার্জিলিং কি উত্তরাখণ্ডের পথে? সত্যি কথা হলো হ্যাঁ, পাহাড়ি শহরগুলোর ভবিষ্যৎ অতি ভয়ংকর। কিন্তু সে কথা কে বুঝবে?
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হিমালয়ান স্টাডিজের গবেষণা বলছে, দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং ও সমগ্র হিমালয়ের পাদদেশের ওপর ‘এনভায়রনমেন্টাল স্ট্রেস’ গত কয়েক বছরে বেড়েছে কয়েকগুণ। জিএসআইকে দিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো উন্নয়নের রাজনীতি। পাহাড়ের নেতারা এই সমীক্ষাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। জিএসআইয়ের সমীক্ষা ও পরে ইউনিসেফের এক প্রকল্পের সূত্রে জানা যায়, দার্জিলিংয়ে মোট প্রায় দুশটি বিপজ্জনক ধসপ্রবণ অঞ্চল আছে। দার্জিলিং হিল কাউন্সিল এই বিপদের বিষয়ে নির্বিকার। তারা একবারও ভাবেন না যে কী করে ধস হওয়ার সম্ভাবনা কমানো যাবে বা ধস হলেও অঞ্চলের মানুষ কীভাবে সামলাবেন। তারা ক্রমাগত নির্মাণের ছাড়পত্র দিচ্ছেন। তারা নিজেদের তৈরি নিয়মকেই স্বার্থের কারণে কীভাবে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো যায়, তার চেষ্টা করেছেন। পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত একবার সুবাস ঘিসিংকে বলেছিলেন, ‘আগে ল্যান্ড বাঁচান, ল্যান্ডই যদি না থাকে তবে গোর্খাল্যান্ড বানাবেন কোথায়?’
দার্জিলিংয়ে ৫৫ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে তিনধারিয়া বাজারে নেমে গেছে যে রাস্তা, গত কয়েক বছরে সেখানে মাটি বসে সিঁড়ির মতো ধাপ তৈরি হয়েছে। লাগোয়া ‘গার্ড ওয়াল’-এর ফাটল বাড়ছে। দার্জিলিং হিমালয়ান রেল সূত্রে জানা গেছে, তিনধারিয়ায় রেলের ‘ওয়ার্কশপ’ এলাকায় বড় ধস নেমেছে আগে। ১৭ মাইলে মাটি বসে যাওয়ায়, কয়েক বছর পর পর রেললাইন তুলে ঠিক করতে হয়েছে। দরজা-জানালা ছিটকানির তালমিল থাকছে না। ঠিক করতে হচ্ছে দু’দিন অন্তর।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের কথা না বললেই নয়। দার্জিলিংয়ের বনসৃজন নিয়ে বনদপ্তর খুব একটা চিন্তিত নয়। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে স্থানীয় বাসিন্দাদের দিয়ে পাহাড়ের শোভাবর্ধনে বিভিন্ন গাছ লাগানো হচ্ছে। কিন্তু যে গাছ মাটি ধরে রাখে, সেই গাছ লাগানো হচ্ছে না। ফলে ভূমিক্ষয় বাড়ছে। নচিকেতার গানের মতো আজ যে কয়লা মন্ত্রী কাল সে শিক্ষামন্ত্রীর মতো এই বিষয়ে অজ্ঞান নেতাদের বনমন্ত্রী করে দেয়ার খেসারত ভবিষ্যতে দেবে দার্জিলিং। নরম মাটিতে পাহাড়ের ঢালে বহুতল নির্মাণ করতে গেলে যে নিখুঁত পরিকল্পনা জরুরি, তা আদৌ হয়েছে কি? উন্নয়ন অবশ্যই দরকার। কিন্তু প্রকৃতি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে উন্নয়নই বিপর্যস্ত হবে। এদিকে রাজনীতির ঔদ্ধত্যে এবং পর্যটনে ল²ীলাভের তাড়নায় পরিবেশ ঢের আগেই মুখ লুকিয়েছে। পরিবেশকে অবিলম্বে স্বার্থসর্বস্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতির বাইরে এক পৃথক সত্তা হিসেবে গণ্য করা প্রয়োজন। অন্যথায় কী হয়, তা প্রমাণ করে দিল জোশীমঠ।
অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।