×

মুক্তচিন্তা

রামরাজ্য ও কৃষক বিদ্রোহ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:৫১ এএম

ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। সেখানে ‘গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় এসে থাকে এবং এসেছে; কিন্তু যারা ক্ষমতাসীন, তারা যে ভারতবর্ষীয় সমাজের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, তা মোটেই নয়; বরং বিপরীত স্থানেই তাদের অবস্থান। নির্বাচনে তাদের জয় আসে জয় শ্রীরাম আওয়াজ তুলেই। ভারতীয় কৃষকদের বিদ্রোহ ছিল শ্রেণিযুদ্ধেরই পদধ্বনি। ধর্মের বর্ম ব্যবহার করে, মুসলিম বিদ্বেষকে জাগিয়ে তুলে, শ্রেণি-নির্যাতনকে আচ্ছাদিত করে রাখার যে পুরনো চেষ্টা, তা ব্যর্থ হতে চলেছে। ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে কৃষকরা চলে এসেছিল রাজধানী দিল্লির অভিমুখে। যে ট্রাক্টর তারা কৃষিক্ষেতে চালাতো, তাকে তারা বাহন করে পৌঁছে গিয়েছিল দিল্লির সীমান্তে। ভয় দেখানো, বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা, প্রলোভন ঝুলিয়ে রাখা- সবই ঘটেছিল। কৃষকরা পিছু হটেনি। তারা দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস ধরে রাস্তায় বসে ছিল। পুরুষ এসেছিল, মেয়েরাও এসেছিল। কৃষি এদের ব্যবসা নয়, কৃষি এদের জীবন; সেখানে বণিক পুঁজির হস্তক্ষেপ এরা ঘটতে দেবে না, প্রাণ দিয়ে হলেও রুখবে; কেননা তারা জানে কৃষি যদি একবার বাণিজ্যের গ্রাসে চলে যায়, তবে কৃষক আর প্রাণে বাঁচবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই মেহনতিদের প্রতি অনেক রকম সহানুভূতি জানিয়েছিলেন, রাজ্যসভায় নিজের উদ্গত অশ্রæ গাত্রবস্ত্র দিয়ে মুছেছেন, কিন্তু বণিকদের মুনাফা লিপ্সা নিবৃত্ত করবেন- এমন সৎসাহস প্রদর্শন করতে পারেননি। কারণ তিনি ওই বণিকদেরই লোক। প্রধানমন্ত্রী মোদিও বলেছেন ঘটনার পেছনে বামপন্থিরা আছে। রাজ্যসভায় তিনি জানিয়েছিলেন, এফডিআই নামের এক শক্তির আগমনের কথা। এফডিআই অর্থ ফরেন ডেস্ট্রাকটিভ আইডিওলজি। বিদেশি মতবাদ স্বদেশে অনুপ্রবেশ করে ধ্বংসাত্মক কাজ চালায়। এটাও কোনো নতুন আবিষ্কার নয়। ভারতের শাসকরা বিদেশি মতবাদের করালগ্রাসী ভয় তো অনেক কাল ধরেই দেখিয়ে আসছেন। বিদেশি মতবাদ অর্থ কমিউনিজম। সেই যে মার্কস-এঙ্গেলস দুই বন্ধু লিখেছিলেন, ১৮৪৮ সালে, কমিউনিজমের ভয় ইউরোপকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সেই ভয় এখনো সব পুঁজিবাদী মহলেরই, এমনকি একদা-সমাজতন্ত্রী রাশিয়া এবং চীনেরও। ব্রিটিশ যুগে ভারতের নেতারা কেউ কেউ নিজেদের সমাজতন্ত্রী বলতে পছন্দ করতেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অতিদ্রুত জানাতেন, তাদের সমাজতন্ত্র কিন্তু মোটেই বিদেশি নয়, খাঁটি স্বদেশি জিনিস। ভারতবর্ষে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য খুব বড় একটা বিপদ কিন্তু লুকিয়ে ছিল ওইখানেই। সমাজতন্ত্রের ওই জাতীয়করণেই। সমাজতন্ত্রের জাতীয় বিজাতীয় রূপ বলে কিছু নেই, যেমন নেই পুঁজিবাদের। সমাজতন্ত্রের মূল কথাটা হলো ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পরে ভারতে যেমন পাকিস্তানেও তেমনি শাসক শ্রেণি বলতেই থাকল, সমাজতন্ত্র চলবে না, কারণ ওটা বিদেশি জিনিস। বিজেপি নেতারা যে ওই একই ভাষায় কথা বলবেন, সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। সমাজতন্ত্রকে জাতীয়তাবাদী চেহারা দিতে চাইলে ঘটনাটা যে কেমন ভয়ংকর হতে পারে, সেটা তো হিটলারের নাৎসিবাদী তৎপরতার পরে বিশ্ববাসীর পক্ষে জানতে আর কিছু বাকি নেই। নরেন্দ্র মোদি আন্দোলনকারী কৃষকদের চিহ্নিত করার জন্য একটি নামও উদ্ভাবন করেছিলেন। ‘আন্দোলনজীবী’। আন্দোলনকারীরা সে নাম শুনে লজ্জিত তো হনইনি, উল্টো বলেছেন, হ্যাঁ, তারা আন্দোলনজীবীই, কিন্তু আন্দোলন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী কী বুঝবেন, তিনি তো কোনো দিন কোনো আন্দোলনে অংশই নেননি। আন্দোলনকারীরা নিশ্চয়ই সাতচল্লিশের দেশভাঙার কথাটা বলেননি, সে সময়ে তো রাজনৈতিকভাবে নরেন্দ্র মোদির জন্মই ঘটেনি, বর্তমানে তিনি যে পুঁজিবাদী হিন্দুত্ববাদ চালু করে দেশবাসীকে নানাভাগে খণ্ড খণ্ড করতে তৎপর রয়েছেন, সে কথাই হয়তো বলতে চেয়েছেন। অবশ্য এ কথাও তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আন্দোলনজীবী হওয়া তো অনেক ভালো চাঁদাজীবী, কিংবা ক্রোনিজীবী (পৃষ্ঠপোষণজীবী) হওয়ার চাইতে। শীতের কনকনে ঠাণ্ডা ও করোনার ভয়ংকর ভীতি, নানাবিধ রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, ভাড়াটে সংগঠন দিয়ে বিভেদ সৃষ্টির চতুর চেষ্টা, প্রলোভন- সবকিছুকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার কৃষক যে পথে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের সেই বিক্ষোভে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কিন্তু খুব একটা সাড়া দেয়নি। এতেও অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ মধ্যজীবীরা আর যাই হোক বিপ্লবী নয়, তারা নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসে, পারলে ঠেলে-ঠুলে ওপরে উঠবে, নিচে নামা নিয়ে তারা সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকে। নিচের মানুষ জেগে উঠুক এটা সে মোটেই চায় না, ভয় ওই মানুষেরা না আবার ভাগ বসাতে আসে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও যে বড় রকমের সাড়া দিয়েছিল, তা নয়। শ্রেণি স্বার্থের শাসনটাকে তারাও মানে বৈকি। কয়েকজন শিল্পী অবশ্য এগিয়ে এসেছিলেন, বোধ করি শিল্পী বলেই। তাই বলে শৈল্পিক সংবেদনশীলতা যেসব শিল্পীর মধ্যেই কাজ করে তাই বা বলি কী করে। ভুবনবিজয়ী শিল্পী লতা মঙ্গেশকার, তার গান শুনেছে অথচ আপ্লুত হয়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। তিনি কিন্তু সাড়া দিয়েছিলেন উল্টো দিকে, সরকারের দিকে। অতিউজ্জ্বল ক্রিকেট তারকা শচীন টেন্ডুলকার; তিনিও ঝুঁকেছেন সরকারের দিকেই। সর্বদা-স্মরণীয় শিল্পীই হোন কী অপরাজেয় ক্রিকেট খেলোয়াড়ই হোন, বস্তুগত স্বার্থের কাছে তারা যখন কাতর হন তখন তো বুঝতে বাকি থাকে না স্বার্থ জিনিসটা কতটা ক্ষমতাধর। বিজেপি ভারতে রামরাজত্ব কায়েম করবে বলে মনস্থ করে। রামরাজ্যের কথা মহাত্মা গান্ধীও বলতেন; তবে তার কল্পনার রাজ্যটি যে সাম্প্রদায়িক হবে এমনটা কখনোই ধারণা করা যায়নি। তাছাড়া শেষ পর্যন্ত তিনি তো প্রাণই দিলেন মুসলমানদের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে গিয়ে এবং যাদের হাতে প্রাণ দিলেন তারা বর্তমান বিজেপির পূর্বপুরুষ বৈ নয়। বিজেপির রামরাজ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, সেখানে মুসলমানরা থাকবে হয়তো, ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দেয়া হবে না, কিন্তু তারা যে বিদেশি, স্থানীয় নয়, এটা মেনে নিয়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই মুখ বুজে থাকতে হবে। গরুর মাংস তাদের জন্য হারাম হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ এতদিন অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষ বলেই পরিচিত ছিল, সেখানকার জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মুসলমান, তারা যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে খুব একটা সুবিধায় আছে, এমন নয়। বিজেপির মাথায় ঢুকেছিল, পশ্চিমবঙ্গ দখল করা চাই। ফলে সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, আক্রান্ত হয় এমনকি বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতিও। যেমন ওই পশ্চিমবঙ্গেরই বিজেপির এক অধুনা-দীক্ষিত নেতা আক্রমণ করেন একেবারে দুর্গা দেবীকেই। দখলদার হতে গেলে যেমনটা হতে হয়, এর ক্ষেত্রেও তা ঘটেছিল। তিনি খেয়াল করেননি যে দুর্গাকে আক্রমণ করার অর্থটা দাঁড়ায় খোদ বন্দেমাতরমকেই আক্রমণ করা; ওই মন্ত্র ও রণধ্বনিতে যার বন্দনা গাওয়া হয়, তিনি মাতৃসম দুর্গা ভিন্ন অন্য কেউ নন; দুর্গা একই সঙ্গে অসুরবিনাশ করেন এবং ফসলের প্রাচুর্য আনেন। বিজেপির ওই উত্তেজিত নেতা নিজেদের জন্য আরও একটি বিপজ্জনক কাজ করে বসেছিলেন; তিনি বলেছিলেন যে দুর্গা খাঁটি নন, শ্রীরামই হচ্ছেন খাঁটি। কারণ দুর্গার কোনো বংশ-পরিচয় নেই, তার পিতা-মাতা কারা, সেটা জানা যায় না; রামের পিতা-মাতা তো বটেই পূর্বপুরুষের পরিচয়ও ইতিহাসে লেখা আছে। এই কথা বলে তিনি রামচন্দ্রের কথিত অবতারত্বকেই অস্বীকার করে বসেছেন; রামকে একজন মানুষ হিসেবে উপস্থিত করেছেন। রামায়ণের রাম অবশ্য নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করতেন, বিষ্ণুর অবতার হিসেবে নয়; বারবার বলেছেন যে তিনি রাজা দশরথের পুত্র। রাম যে দেবতা নন, মানুষই একজন, এটা তাকে নিয়ে লেখা মহাকাব্যটিতে অত্যন্ত সুন্দর ও সুস্পষ্টভাবে উপস্থিত। তিনি আদর্শ পুরুষ, কিন্তু মানুষই। রাজত্ব করতে গিয়ে তিনি জনরঞ্জন নীতি নিয়েছিলেন এবং পতœী সীতাকে রাক্ষস রাবণের বন্দিপুরী থেকে উদ্ধার করে আনার পরে প্রজাদের গুঞ্জন শুনে পতœীর সতীত্ব প্রমাণের জন্য অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন করেছিলেন। পরীক্ষায় পুরোপুরি কৃতকার্য হওয়ার পরও যেহেতু গুঞ্জন থামেনি, তাই সীতাকে তিনি নির্বাসনেই পাঠিয়ে দিলেন। দুই সন্তানের জননী হিসেবে পরে সীতাকে ফেরত নিয়ে এসেছিলেন; কিন্তু তারপরও যখন সীতার সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল সীতা তখন আর সহ্য করতে পারলেন না, রামকে ধিক্কার দিয়ে নিজের জননী ধরিত্রীকে দ্বিধা-বিভক্ত হতে বললেন এবং পাতালে চলে গেলেন। ভূমি থেকে উঠে এসেছিলেন ভূমিতেই আশ্রয় নিলেন। ঠিক যেমনটি ছিল ভারতের বিক্ষোভকারী কৃষকদের দশা। তারা ভূমির মানুষ, বারবার পরীক্ষা দেয়, লাঞ্ছিত হয়; কিন্তু ভূমির আশ্রয় ছাড়ে না। অন্যদিকে যারা তাদের লাঞ্ছিত করে, তারা অতিশয় উত্তেজিতরূপেই শ্রীরামভক্ত। নতুন যুগের রামভক্তদের হাতে সীতার লাঞ্ছনা চলছে। রামের ভেতর যে পুরুষতান্ত্রিকতাটা ছিল সেটাই যেন বের হয়ে এসে ভর করেছে এই রামভক্তদের কাঁধে। রামের দাক্ষিণাত্যবাসী ভক্তরা হয়তো মানুষই ছিল, কিন্তু রামায়ণের কবির হাতে তারা মানুষ নয় হনুমান হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে বসে আছে। এসব তো গেল, কিন্তু একজন বিজেপি নেতা কী করে দাবি করেছিলেন- রাম দেবতা নন, মানুষই ছিলেন? রাম ইতিহাসের মানুষ, অলৌকিক নন? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App