×

সারাদেশ

ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে চেয়ারম্যানের অর্থ আত্মসাৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০৩:৪২ পিএম

ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে চেয়ারম্যানের অর্থ আত্মসাৎ

ছবি: ভোরের কাগজ

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক সরকারের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের ৫ জন সদস্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন।

অভিযোগ সূত্রে, পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নে কাগজে-কলমে সামাজিক ও গ্রামীণ উন্নয়নমূলক (এলজিএসপি, উন্নয়ন সহায়তা তহবিল, গ্রামীন অবকাঠামো) নানা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন দেখানো হলেও বাস্তবে করা হয়নি। ভুয়া প্রকল্প বা একই প্রকল্প একাধিকবার দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক সরকার।

এছাড়াও বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় ১৪ মাস ধরে ইউনিয়ন পরিষদের বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচন না করে পরিষদের সদস্য ও সুবিধাভোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ ও কোনো বিষয়ে পাত্তা না দেওয়ার অভিযোগ ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধান ও কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বাস্তবে একটি প্রকল্পেও পরিপূর্ণভাবে কাজ শেষ করার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজই করা হয়নি। পাঁচ-ছয়টিতে নামমাত্র কাজ হয়েছে।

জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে এলজিএসপি প্রকল্পের আওতায় পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৬টি ইউড্রেন নির্মাণের জন্য ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্পে নজরুলের বাড়ির সামনে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে তিনটি ইউড্রেন ও মজির উদ্দিনের বাড়ির পাশে রাস্তায় ১ লাখ ৯৯ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ইউড্রেন নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাস্তবে সেই ইউড্রেনের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অথচ কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে প্রকল্পের টাকা তুলে নিয়েছেন চেয়ারম্যান।

এলাকাবাসী বলেন, গত বছর ২টি ইউড্রেন তৈরি হলেও বাকিগুলোর হদিস নেই। ইউড্রেন না থাকায় বর্ষা মৌসুমে আমরা জলাবদ্ধতায় ভুগি। চেয়ারম্যানকে বারবার বলেও লাভ হয়নি। তিন নম্বর ওয়ার্ডে ইউপি চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই ময়নুলের বাড়ির পাশের নামমাত্র প্যালাসাইটিং নির্মাণ করে একই প্রকল্পে দুই দফায় ৭ লাখ ২২ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য মামনুর রশিদ জানান, পশ্চিম ছাতনাই মৌজার বিভিন্ন রাস্তার ভাঙ্গায় আরসিসি রিং পাইপ স্থাপন না করেই বরাদ্দের ২ লাখ চল্লিশ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে চেয়ারম্যান ।

ছয় নম্বর ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ছাতনাই মৌজায় তথ্য সেবার নামে ফটোকপি মেশিন না কিনেই ২৪ হাজার ৬৬৫ টাকা বিল উত্তোলন করা হয়েছে। এ মৌজায় কোন তথ্য সেবা কেন্দ্র নেই। একই অর্থ বছরে ইউনিয়নের হাট বাজার থেকে পাওয়া অর্থের ৪৬ ভাগ অর্থ ইউপি সদস্যদের সম্মানী বাবদ ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৯২০ টাকা খরচ দেখানো হয়।

ইউপি সদস্য নুর ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম, মামুনুর রশিদসহ কয়েকজন বলেন, ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এক বছর পার হলেও এ পর্যন্ত আমরা পরিষদ থেকে কোন সম্মানী ভাতা পাইনি।

তারা জানান, ইউপিতে কখন কিসের বরাদ্দ আসে, তার কোনো মাসিক সভা, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড না থাকায় তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে,২০২১-২২ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন রক্ষনাবেক্ষণ প্রকল্পের আওতায় আইয়ুব খা ও মুক্তা বেগমের বাড়ির রাস্তার পাশে পুকুরে প্যালাসাইটিং এবং রাস্তার ভাঙ্গায় আরসিসি রিং পাইপ স্থাপন করার জন্য ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। এই প্রকল্পের সভাপতি চেয়ারম্যান নিজেই। কিন্তু কাজ না করেও কাগজে-কলমে কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে টাকা তোলা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আবু বক্কর ও আব্বাস আলী জানান, আইয়ুব খার বাড়ির পাশের পুকুরের প্যালাসাইটিং দুই বছর আগে এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে বসানো হয়েছিল। আর মমতা বেগমের বাড়ির রাস্তার পাশের কোন পুকুরেই প্যালাসাইটিং নির্মাণ করা হয়নি।

তারা বলেন, এই এলাকার কিছু রাস্তার ভাঙ্গায় আরসিসি রিং পাইপ স্থাপনের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও কাজ হয়নি। অথচ তারা কীভাবে কাজ না করেও বিল তুলেছেন, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন।

তিন নম্বর ওয়ার্ডে সুফিয়ারের দোকানের পাকা রাস্তা হতে নাজমুলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ও প্যালাসাইটিং নির্মাণের জন্য টিআর প্রকল্পের ৫ মেট্রিক টন ৪০০ কেজি চাল বরাদ্দ হলেও এখানে কাজ হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্পের সভাপতি ইউপি সদস্য রশিদা বেগম বলেন, কাজ না হলে বিল কিভাবে দিলো?

কোথায় কবে কাজ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কিছু জানি না চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেন। বলেই ফোন কেটে দেন।

এ ছাড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম ছাতনাই মৌজায় রিং পাইপ সরবরাহে ১ লাখ ৮২ হাজার, ৩ নং ওয়ার্ডে ঈদগাহ মাঠ থেকে রশিদুলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বারিকের বাড়ি থেকে আব্দুল হাইয়ের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার ৩ লক্ষ ২৭ হাজার ৬৭৯ টাকা, ছাতনাই মহাবিদ্যালয় মাঠে মাটি ভরাট বাবদ ৫ মেট্রিক টন ৪০০ কেজি চাল বরাদ্দ দেওয়া হয় ।

কিন্তু বেশিরভাগ প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে প্রতিটি প্রকল্পের টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন চেয়ারম্যান বলেন ইউপি সদস্য ও স্থানীয়রা।

ইউপি সচিব আনিসুর রহমান বলেন, আমি গত পাঁচমাস থেকে এখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। বেশিরভাগ প্রকল্প আমার যোগদানের আগেই সম্পন্ন হয়েছে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পশ্চিম ছাতনাই ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক সরকার বলেন, কয়েকজন ইউপি সদস্য ষড়যন্ত্র করে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।

তিনি বলেন, নির্বাচনে অনেক প্রতিপক্ষ থাকে। একজন চেয়ারম্যানের অভিযোগ হতেই পারে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত চলছে বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, ইউপি সদস্যদের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলমান। তদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App