×

মুক্তচিন্তা

নতুন কারিকুলামে বিজ্ঞান শিক্ষা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:৫০ এএম

আমরা জানি ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে, যা শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সাল থেকে; কিন্তু কোভিডের কারণে বিলম্ব হয়েছে। এই কারিকুলাম অনুযায়ী লেখা নতুন বই ৬২টি বিদ্যালয়ে পাইলটিং করা হয়েছিল, যদিও ২০০টিতে পাইলটিং হওয়ার কথা ছিল। আশা ছিল আমরা এই পাইলটিংয়ের ফল জানতে পারব, ফিডব্যাক দিতে পারব কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি। সব বিদ্যালয়ে এখনো বই পৌঁছায়নি, ইতোমধ্যে পাঠ্যবইয়ে একের পর এক ভুল বের হতে শুরু করেছে, কিছু কিছু ভুল মারাত্মক এবং কিছু কাজ রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়ার মতো। ভুল ও অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য দিয়ে পাঠ্যবই ছাপানোয় উদ্বিগ্ন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পুস্তক প্রণয়নে অযতœ ছিল। বই লেখা ও সম্পাদনায় অসতর্ক ছিলেন লেখক-সম্পাদকরা। আর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তদারকির অভাব ছিল। ফলে বইয়ের লেখক, সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এগুলোর দায় এড়াতে পারেন না। যদিও এনসিটিবির কেউ কেউ বলছেন, বইয়ে ভুল থাকার মূল দায় লেখক ও সম্পাদকের। যাদের বইয়ে বড় ধরনের ভুল পাওয়া গেছে, আগামীতে তাদের লেখার সঙ্গে যুক্ত কোনো কাজে অংশগ্রহণ করাবেন না। নতুন শিক্ষাক্রমে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে শিখনকালীন মূল্যায়ন। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বেশির ভাগ মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে। অর্থাৎ বিষয় শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সারা বছর ধরে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজ, প্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চা, খেলাধুলা, গ্রুপ ওয়ার্ক, কুইজ, পোস্টার প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাবেন এবং তাদের কাজের মূল্যায়ন করবেন। মূল্যায়ন মানে বর্তমানকালের মতো প্রচলিত পরীক্ষা নয়, নম্বর নয়, গ্রেডিং নয়। নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে সে সম্পর্কে শিক্ষক মন্তব্য করবেন। মন্তব্যগুলো হবে- খুব ভালো, ভালো, সন্তোষজনক এবং আরো শেখা প্রয়োজন এ ধরনের। ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শ্রেণিতে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া বা নম্বর ও গ্রেডিংয়ের পেছনে ছোটার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সেটি থাকবে না। এখানে শিক্ষকের ভূমিকাই হবে মুখ্য। তাদের বহুমাত্রিক সৃজনশীল, দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ ও মানবিক গুণসম্পন্ন আদর্শ শিক্ষক হতে হবে। এ কথাগুলো খুবই চমৎকার, কর্ণ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু বাস্তব কী বলে? সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় পৃষ্ঠার শুরুতে বলা হয়েছে, জীববৈচিত্র্য কী। পাঠ্যপুস্তকটিতে লেখা হয়েছে, জীববৈচিত্র্য বা বায়োডাইভারসিটি শব্দ দ্বারা পৃথিবীতে জীবনের বিপুল বৈচিত্র্য বর্ণনা করা হয়। জীববৈচিত্র্য বলতে উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীবসহ সকল জীবের মধ্যে বিদ্যমান বৈচিত্র্যকে বোঝায়। পৃথিবীতে ঠিক কতসংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন জীব আছে, তা নিশ্চিত করে এখনো আমাদের জানা নেই। তবে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে, প্রায় ৮-১৪ মিলিয়ন (৮০ থেকে ১৪০ লাখ) বিভিন্ন প্রজাতির জীব এই পৃথিবীতে রয়েছে। কারো কারো ধারণা মতে, সংখ্যাটা আরো বেশি। তবে সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, এসব জীবের বেশির ভাগই আমাদের অজানা। এখন পর্যন্ত মাত্র ১.২ মিলিয়ন (১২ লাখ) প্রজাতি শনাক্ত এবং বর্ণনা করা হয়েছে, যার অধিকাংশই অবশ্য পোকামাকড়। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, কোটি কোটি অন্যান্য জীব এখনো আমাদের কাছে রহস্যময়, অজানা। হুবহু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডট ওআরজি ((যঃঃঢ়ং://বফঁপধঃরড়হ. হধঃরড়হধষমবড়মৎধঢ়যরপ. ড়ৎম/ ৎবংড়ঁৎপব/নরড়ফরাবৎংরঃু) থেকে এ তথ্যগুলো উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বিদেশি ভাষা থেকে ভাষান্তর করে লেখা পাঠ্যপুস্তক অনেক রয়েছে। তবে ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্তি স্বীকার না করে হুবহু মেরে দেয়া একাডেমিক ভাষায় ‘চৌর্যবৃত্তি’ বা প্লেইজারিজম। তাহলে প্রথম প্যারাগ্রাফে নতুন কারিকুলামের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে কথাগুলো বলা হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে নতুন বইয়ের কী মিল রইল? পঞ্চম পাতায় জীবের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতি বেঁচে থাকার জন্য এবং সেগুলোর বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একসঙ্গে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, চারণভূমির ঘাস গবাদিপশু খায়। গবাদিপশু যে মল ত্যাগ করে, তা সার তৈরি করে, যা মাটিতে পুষ্টি ফেরত দেয়, যা আরো ঘাস জন্মাতে সাহায্য করে। এই সার ফসলি জমিতে প্রয়োগ করার জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক প্রজাতি খাদ্য, পোশাক এবং ওষুধসহ নানা উপকরণ প্রদান করে মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নবম পৃষ্ঠায় ‘জীববৈচিত্র্যের ঝুঁকি ও প্রতিকার’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে পৃথিবীর বেশির ভাগ জীববৈচিত্র্য মানুষের ব্যবহার এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডের কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা বাস্তুতন্ত্রকে বিশৃঙ্খল করে, এমনকি কখনো কখনো বিনষ্টও করে ফেলে। দূষণ, জলবায়ু, পরিবর্তন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি সবই জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। এই হুমকি প্রজাতি বিলুপ্তির পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে। কিছু বিজ্ঞানী অনুমান করেছেন যে, আগামী শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর সব প্রজাতির অর্ধেক নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এগুলো হুবহু জিওগ্রাফিক টি ওআরজি থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। কোনো সূত্রের উল্লেখ নেই। মনে হচ্ছে লেখকরা নিজেরাই জরিপ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এটিতো এক ধরনের দায়সারা গোছের কাজ। জাতীয় কারিকুলামের ক্ষেত্রে কি আমরা এ ধরনের কাজ করতে পারি? এ ধরনের বহু নকল, ভুল ও অসঙ্গতি রয়েছে বইয়ে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করার অভিযোগ স্বীকার করেছেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার ও অধ্যাপক ড. হাসিনা খান। জাফর ইকবাল স্যার বলেছেন, প্লেইজারিজমের জন্য তারা খুবই লজ্জিত, খুবই বিব্রত। আগামীতে ভুল সংশোধন করবেন বলে তিনি সংকল্পবদ্ধ। স্যার এই অংশটি নিজে লেখেননি, তবে সম্পাদক হিসেবে তার ওপরই দায়িত্ব বর্তায়। তিনি তার দায় স্বীকার করেছেন, যা প্রশংসনীয়। স্যার নিজে লেখেননি, তবে সম্পাদক হিসেবে তার কাছ থেকে আশা করেছিলাম সঠিক মানের একটি বিজ্ঞান বই আমরা পাব। যাই হোক, কোনো কারণে হয়নি। তাই স্যার ভুল স্বীকার করে নিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। এটি না হয় স্যারের ক্ষেত্রে ঘটেছে অন্যান্য বইয়েও তো শত শত ভুল বের হচ্ছে। কয়েক দিন আগে দেখলাম বিভিন্ন বইয়ের লেখকরা এনসিটিবির নতুন বইয়ে কে কতটা অবদান রেখেছেন, কে কতটা চ্যাপ্টার লিখেছেন ইত্যাদি প্রকাশ করে ক্রেডিট নেয়ায় কার্পণ্য করেননি। সব বিষয়ের বইয়েই কিছু কিছু বিষয় ও চ্যাপ্টার অনেক ভালো আছে কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় হতাশাজনক অবস্থা। এর দায় কি লেখকরা নেবেন? বিজ্ঞান একটি আনন্দের বিষয়, কনসেপ্ট পরিষ্কার থাকার বিষয়। কিন্তু আমরা অন্য বিষয়ের মতো নকল আর মুখস্থের মতো বিষয় দিয়ে এত বাহবা নেয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলাম যে, এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কারিকুলাম আর কোথাও নেই। আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কিন্তু এসব বই দেখেননি এবং কোনো কমেন্টও করেননি। সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও গবেষক বাংলাদেশের নতুন বই নিয়ে কমেন্ট করেছেন। আমি যে উদাহরণ দিলাম সেটি তাদেরই বের করা বিষয়। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষকরা খবরই রাখেন না যে, দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় এতকিছু ঘটে যাচ্ছে। বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদের কাছাকাছি দেশ চীনের দিকে যদি একটু তাকাই তাহলে দেখা যায় যে, বিজ্ঞান শিক্ষা ও সক্ষমতায় সেখানে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। বিজ্ঞানে চীনের এই অধিপত্য বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করে ফেলে কিনা, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে চীন সরকার বিগত বছরগুলোতে যেসব নীতি নিয়েছে, তারই ফল চীনের আজকের এই সাফল্য। ২০০০ সালের দিকেও চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা অনেকগুণ বেশি বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করতেন। গত তিন দশক চীন সরকার দেশটির গবেষণা সক্ষমতা বাড়াতে অনেক গুণ বিনিয়োগ বাড়ায়। এ সময় চীন শিক্ষার্থী ও গবেষকদের পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে পাঠায়। ব্যবসায়ীদেরও হাই-টেক পণ্য উৎপাদনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত চীন ৫২ লাখ শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞকে পড়াশোনার জন্য বাইরে পাঠিয়েছে। এর বেশির ভাগই বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের বিভিন্ন বিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন। তারা বেশির ভাগই দেশে ফিরে বিজ্ঞান গবেষণার ও হাই-টেক কোম্পানিগুলোতে কাজ করছেন। আর আমরা কপি পেস্ট করে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শেখানোর চিন্তা করছি। উচ্চ গুণমানসম্পন্ন বিজ্ঞান সৃষ্টির ক্ষেত্রে চীন বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশেরই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে সেরা বিজ্ঞান সাময়িকীগুলোতে অন্য যে কোনো দেশের গবেষকদের তুলনায় বেশি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করছে চীন। গুগল আমাদের বাংলা ভাষায় এখনো সঠিকভাবে ভাষান্তর করার সক্ষমতা অর্জন করেনি। ভুলভাল ইংরেজিতে বাংলার ভাষান্তর হয়, যা শিক্ষার্থীদের ভুল বার্তা দেয়, সঠিক বিজ্ঞান না শিখে ভুল বিজ্ঞান শেখার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এসব কারণে এনসিটিবির কোনো ক্ষতি হয় না, ক্ষতি হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের, যারা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। তারপরও আমাদের লেখকরা এটি কেন করলেন? তারা যে সিনসিয়ার নন সেটি প্রকাশ পেল। তারা জানেন যে, বাংলাদেশের কোনো শিক্ষক এসব পড়বেন না, এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না, অতএব কোনো ঝামেলা নেই। তারা বাংলাদেশের শিক্ষকদের সম্পর্কে ঠিকই চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশেরই কিছু শিক্ষক ও গবেষক তো আছেন যারা বিদেশের মাটিতে নিজেদের সৃজনশীলতা ও গবেষণাকর্ম প্রদর্শন করে ওইসব দেশের শিক্ষা ও বিজ্ঞানে প্রভূত অবদান রেখে চলেছেন, কারণ শিক্ষা নিয়ে সেখানে রাজনীতি অনেক কম, কিংবা নেই-ই। তারা তো প্রকৃত গবেষক, বিজ্ঞান নিয়ে কোথায় কী হচ্ছে, তারা তো একটু ঘেঁটে দেখবেনই। আর তাদের দেখার কারণে হয়েছে ঝামেলাটা। এনসিটিবি এখন কী করবে? সুন্দর করে একটি বিবৃতি দেবে। এটি আমরা সবাই জানি। মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App