×

জাতীয়

পাহাড়ে সন্ত্রাসী-জঙ্গি একাকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:২১ এএম

পাহাড়ে সন্ত্রাসী-জঙ্গি একাকার

প্রতিকি ছবি

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর যোগসাজস

দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ এবং তৎপরতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাধিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ হয়েছে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নাম।

পাহাড়ের অস্থিরতা সৃষ্টির নেপথ্যে দেশি-বিদেশি চক্রের যে ষড়যন্ত্র রয়েছে তার অংশ হিসেবে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও জঙ্গিদের সমন্বয় করা হয়েছে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাদের মতে, জঙ্গিদের পাহাড়ে আস্তানা করার প্রধান অনুপ্রেরণা হতে পারে আফগানিস্তানের তালেবান শাসন। আফগানিস্তানে বিস্তৃত পাহাড় থাকায় পাহাড়েই ঘাঁটি গড়ে তোলে তালেবান। পরে লোকচক্ষুর আড়ালে সেখানে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের মজুত করে। এরপর আফগানিস্তানের শাসনই তাদের হাতে চলে আসে। বাংলাদেশে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে যে নতুন জঙ্গি সংগঠনের উত্থান হয়েছে সেটি অনেকটা তালেবানকে অনুসরণ করে। ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তালেবানের মতো ক্ষমতাধর হতে পাহাড়কে বেছে নিয়ে থাকতে পারে। এরপরের বিষয় হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা।

গত কয়েক বছরের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের চিত্র দেখলে বোঝা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমতলের অনেক জায়গায় জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু পাহাড়ে বিষয়টি তেমন নয়। অত্যন্ত দুর্গম এবং আত্মগোপনের যথেষ্ট সুযোগ থাকায় প্রশিক্ষণ ও ঘাঁটি হিসেবে পাহাড়কে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভাবছে জঙ্গিরা। তাছাড়া সেখানকার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সমর্থন ও সহযোগিতা পাচ্ছে তারা।

এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেছেন, অভিযান ও গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে জঙ্গিদের সমতলে বিচরণ কঠিন হয়ে পড়েছে। সেজন্য তারা নিরাপদ আস্তানা হিসেবে পাহাড়কে বেছে নিয়েছে।

কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিট (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, অপরাধীরা প্রতিনিয়ত কৌশল পাল্টায়। জঙ্গিরা পাহাড়কে নিরাপদ ভাবছে অনেক কারণে। তারা মনে করে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এবং জঙ্গি নিয়ে যারা কাজ করে পাহাড়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ কম। এসবকে তারা সুযোগ হিসেবে দেখে। এছাড়া সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও জঙ্গিদের মিলেমিশে থাকার খবর নতুন নয়, অনেক আগে থেকেই তারা একত্রে আছে।

র‌্যাবের মুখপাত্র কামান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, তাত্ত্বিক জ্ঞান, অস্ত্র চালানো ও প্রশিক্ষণের জন্য নিরপাদ ভেবে জঙ্গিরা পাহাড়ে গিয়েছে। সমতল তারা নিরাপদ ভাবছে না। এছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের প্রায় ২০০ জন সদস্য রয়েছে। জঙ্গিরা সেখানে থাকা-খাওয়া ও প্রশিক্ষণের জন্য কেএনএফকে মাসে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা করে দিয়ে আসছে। এজন্য কেএনএফ তাদের সঙ্গে রয়েছে। এ অবস্থায় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া জঙ্গিরা শক্তিশালী হলে কেএনএফও শক্তিশালী হচ্ছে। র‌্যাব ও সিসিটিসি কর্মকর্তারা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে নির্জনে পাহাড়কে নিরাপদ মনে করছে জঙ্গিরা। কারণ, দুর্গম পাহাড়ে আস্তানা শনাক্ত করে অভিযান চালাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হবে। আর পাহাড়ে জায়গা দখল করাও সহজ। সহযোগিতা নেয়া যায় বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর। নির্ভয়ে মজুত করা যায় অস্ত্রসামগ্রী। এর বাইরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য মানসিকভাবেও যে কেউ পাহাড়ের কথাই চিন্তা করবে। সুতরাং যারা জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন, মানসিকভাবে তারা পাহাড়কে নিরাপদ মনে করাও একটি বড় কারণ।

স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্র মতে, তিন পার্বত্য এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মূলত ছয়টি সন্ত্রাসী সশস্ত্র সংগঠন। এরা হলো- জেএসএস, জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ, গণতান্ত্রিক এমএনপি (মগ গণতান্ত্রিক পার্টি) এবং সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। কেএনএফ সংগঠনটিকে পাহাড়িরা ‘বম পার্টি’ নামে চেনেন। সন্ত্রাসী গ্রুপের দৌরাত্ম্যের মধ্যেই জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে এক জঙ্গি সংগঠন সেখানে তৎপরত হয়ে উঠেছে। নিচ্ছে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। তাদের ধরতে চলছে র‌্যাবের অভিযান। গত কয়েক মাসে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের থানচি ও রোয়াংছড়িসহ দুর্গম এলাকা থেকে প্রায় অর্ধশতাধিক জঙ্গিকে আটক করেছে র‌্যাব।

জানা গেছে, কয়েক বছর আগে জঙ্গি সংগঠন হুজির পাহাড়ে আস্তানা গাড়ার খবর প্রকাশ পায়। আফগানিস্তান ফেরত জঙ্গিদের এই দলটি গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমারের মুসলমান রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নেয়া। নব্বইয়ের দশকে রোহিঙ্গাদের দুই সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (এআরএনও) সঙ্গে হুজির সম্পর্কের খবরও আলোচনায় আসে। উগ্রবাদ বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণকারী সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালের ২৬ ও ২৭ আগস্ট বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির জঙ্গল থেকে পুলিশ, বিডিআর ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল। তাদের ২০০৫ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী, বান্দরবানে জেএমবির বেশ তৎপরতা ছিল। তারা রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। এভাবে পাহাড়ে আশ্রয় নিলেও পাহাড়ি কোনো সংগঠনের সঙ্গে মুসলিম জঙ্গিদের যোগসাজশের খবর আগে পাওয়া যায়নি।

এদিকে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি হলেও তিন পার্বত্য জেলায় চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে অনেকগুলো গ্রুপ জড়িত। এগুলো হচ্ছে- ইউপিডিএফ (মূল), ইউপিডিএফ (ডেমোক্র্যাটিক), জেএসএস (মূল), জেএসএস (রিফর্মিস্ট) ও কেএনএফ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফন্ট)। এছাড়া রয়েছে- ওয়াই ডি এফ (ইয়ুথ ডেমোক্র্যাটিক ফন্ট), পিসিপি (পার্বত্য ছাত্র পরিষদ) ও এইচ ডব্লিউ এফ (হিল উইমেন ফেডারেশন)। কেএনএফের অবস্থান বান্দরবানের সাইজাম পাড়ায় পাওয়া যায়। কেএনএফ রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির শিনজিপাড়ায় চাঁদাবাজি করে থাকে। মিয়ানমার ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এমএনপি) চাঁদাবাজি করে কাপ্তাই এলাকায়। সেখানে মূল দুটি বড় সংগঠনের আধিপত্য রয়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন হোটেল-মোটেল, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং কাঠ ব্যবসায়ীসহ নানা প্রতিষ্ঠান মাসে নির্ধারিত হারে চাঁদা দিয়ে থাকে উল্লেখিত সংগঠনের সন্ত্রাসীদের। এখন নতুন করে যোগ হয়েছে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App